ফোন কলে বাল্যবিবাহ বন্ধ

বাল্যবিবাহ ও ইভ টিজিং প্রতিরোধে প্রশাসনের সচেতনতামূলক বিলবোর্ড। গুরুদাসপুরের চাঁচকৈড় বাজারে।  ছবি: প্রথম আলো
বাল্যবিবাহ ও ইভ টিজিং প্রতিরোধে প্রশাসনের সচেতনতামূলক বিলবোর্ড। গুরুদাসপুরের চাঁচকৈড় বাজারে। ছবি: প্রথম আলো

স্কুলে যাওয়া–আসার সময় সড়কের ধারে একটি বিলবোর্ড প্রায়ই চোখে পড়ত নাটোরের গুরুদাসপুরের ধানুড়া বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বিউটি খাতুনের। বিলবোর্ডে লেখা ছিল সচেতনতামূলক বার্তা আর ইউএনওর মুঠোফোন নম্বর। গত ২৮ জুলাই বিলবোর্ডের ওই নম্বরটিই বিপদের সময় কাজে আসে। মুঠোফোনের একটি কলে বিউটি বন্ধ করে নিজের বাল্যবিবাহ

বিউটি এখন নবম শ্রেণিতে পড়ছে। স্কুলেও যাচ্ছে নিয়মিত। বাল্যবিবাহ বন্ধে সচেতন করছে সহপাঠীদের। পরিবারের ভুল সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে বাল্যবিবাহ ঠেকানোর স্বীকৃতি হিসেবে বিউটিকে পুরস্কৃত করেছে উপজেলা প্রশাসনও।

বিউটির পর গুরুদাসপুরে বন্ধ হওয়া বাল্যবিবাহের তালিকা আরও লম্বা হয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী, গত জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৩০টি বাল্যবিবাহ বন্ধের ঘটনা ঘটেছে। এর বাইরে ১০টি বিয়ে বন্ধ হয়েছে উপজেলা প্রশাসনের সাঁড়াশি অভিযানে।

গুরুদাসপুরের বিভিন্ন সড়ক ঘুরে দেখা গেল বিলবোর্ডগুলোতে বাল্যবিবাহের বয়স, সাজা, মেয়েদের উত্ত্যক্ত ও প্রতিকার পেতে সহযোগিতার জন্য দেওয়া আছে হেল্পলাইন নম্বর। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও চালানো হচ্ছে প্রচারণা। উৎসাহ দিতে যাঁরা বাল্যবিবাহ বন্ধে সহায়তা করছেন, তাঁদের পুরস্কৃতও করছে উপজেলা প্রশাসন। এসব কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিজে। ইউএনও তমাল হোসেন এ কার্যক্রমকে দেখছেন একটি সামাজিক আন্দোলন হিসেবে।

তমাল হোসেন বলছিলেন, এ ধরনের আন্দোলনে এখন সাড়া দিচ্ছেন সচেতন সাধারণ মানুষও। গত ২৯ অক্টোবর রাতে উপজেলার ধারাবারিষা  ইউনিয়নের সিধুলি গ্রামে রাত ১১টার দিকে অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রীর বাল্যবিবাহের আয়োজন করা হয়েছিল। বিয়ে বন্ধ করতে এবার এগিয়ে আসেন স্থানীয় লোকজন। বিলবোর্ডে থাকা মুঠোফোনে কল দিয়ে তাঁরা বাল্যবিবাহের কথা জানালে ওই বিয়ে বন্ধ করা হয়। প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত মেয়ের বিয়ে না দেওয়ার মুচলেকা দিয়েছে তার পরিবারও।

ইউএনও বলেন, অভিভাবকদের অসচেতনতা, অজ্ঞতা আর নেতিবাচক মনোভাবের কারণে উপজেলাজুড়ে বাল্যবিবাহের প্রবণতা বেশি। এ ছাড়া স্কুল-কলেজে যাতায়াতের সময় অনেক মেয়েই বখাটেদের উত্ত্যক্তের শিকার হচ্ছে। এটিও বাল্যবিবাহের অন্যতম কারণ। বাল্যবিবাহের কারণে অষ্টম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত গিয়েই স্কুল থেকে ঝরে পড়ছে ছাত্রীদের বড় একটি অংশ।

উপজেলা প্রশাসনের কার্যালয় থেকে জানা গেল, পুরো উপজেলাকে বাল্যবিবাহমুক্ত করতে বিলবোর্ডের পাশাপাশি প্রচারপত্র বিতরণ, মাইকিং, স্কুল-কলেজগুলোতে বিতর্কের আয়োজন করা হচ্ছে। বাল্যবিবাহ ও নারীদের উত্ত্যক্ত করা (ইভ টিজিং) নিয়ে তৎক্ষণাৎ অভিযোগ জানাতে চালু করা হয়েছে একটি বিশেষ নম্বর। তা হলো ০১৩১৫ ১৭১৩৫৪।

এর বাইরেও বাল্যবিবাহ রুখতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ রাখছে উপজেলা প্রশাসন। বাল্যবিবাহের খবর পেলে প্রকাশ্যে অথবা ছদ্মবেশে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হচ্ছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সহকারী কমিশনার (ভূমি) কিংবা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা।

ইউএনও তমাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন,  দেশের প্রতিটি উপজেলায় যদি এমন কার্যক্রম নেওয়া হয়, তাহলে একেকটি উপজেলা বাল্যবিবাহমুক্ত হতে হতে একদিন সারা দেশ থেকে বাল্যবিবাহ দূর হবে।

উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তমাল হোসেন গত জুন মাসে যোগদান করেছেন। উপজেলার এক সমন্বয় সভায় ‘বাল্যবিবাহ-ইভ টিজিং’ বিষয়ে আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তাব রাখেন তিনি। পরে তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।

গত ১১ অক্টোবর উপজেলার বিয়াঘাট ইউনিয়নের যোগেন্দ্রনগর গ্রামে বন্ধ হয় দশম শ্রেণির এক ছাত্রীর বাল্যবিবাহ। পরে ওই ছাত্রীর ভাইকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করে উপজেলা প্রশাসন। মেয়েটি বলছিল, ‘বিয়ে বন্ধ হওয়ায় এখন আবার স্কুলে যাই। হারাতে বসা শৈশবটাও ফিরে পেয়েছি।’