ঝালকাঠির এক স্টেডিয়ামে গরু চরে

বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর স্টেডিয়ামে গরু চরানো হচ্ছে।  প্রথম আলো
বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর স্টেডিয়ামে গরু চরানো হচ্ছে। প্রথম আলো

ঝালকাঠিতে খেলাধুলার প্রাণকেন্দ্র ক্রীড়া সংস্থার দুটি স্টেডিয়াম। অথচ দুটি স্টেডিয়ামই এখন বেহাল। ক্রীড়া সংস্থার আয়োজনে দীর্ঘদিন ধরে কোনো বড় টুর্নামেন্ট হচ্ছে না জেলায়। খেলাধুলা চলমান না থাকায় বড় স্টেডিয়ামটি পরিণত হয়েছে গরুর চারণক্ষেত্রে। 

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কোনো খেলাতেই ঝালকাঠি থেকে জাতীয় মানের খেলোয়াড় তৈরি হচ্ছে অনেক দিন হলো। অথচ কলকাতার খেলোয়াড়েরা একসময় ঝালকাঠিতে খেলতে আসতেন নিয়মিত। ঝালকাঠিরও অনেকে কলকাতায় যেতেন খেলতে। কিন্তু সেই ঐতিহ্য এখন আর নেই। 

জেলা ক্রীড়া সংস্থা সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৪ সালে গঠিত হয় এই ক্রীড়া সংস্থা। এর অধীনে জেলা শহরে দুটি স্টেডিয়াম আছে। পুরোনোটি ঝালকাঠি শহরের থানা সড়কে অবস্থিত, নাম শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম। এটি সাড়ে তিন একর জায়গার ওপর গড়ে উঠেছে। এই স্টেডিয়ামের দুটি গ্যালারি অনেক আগে থেকে পরিত্যক্ত হয়ে আছে। মাঠও খেলাধুলার অনুপযোগী। ফলে এই স্টেডিয়ামে এখন কেবল শিশু–কিশোরদের বিভিন্ন খেলাধুলার অনুশীলন কার্যক্রম চলছে। এ ছাড়া এই মাঠেই আয়োজন হয় স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক জনসভা। ফলে মাঠটি আর বড় মঞ্চের খেলোয়াড় তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারছে না।

নতুন স্টেডিয়ামটি শহরতলির বিকনা মৌজায় সাড়ে ৯ একর জমিতে নির্মিত। ৬ কোটি টাকায় নির্মিত এই স্টেডিয়ামটি উদ্বোধন হয় ২০০৭ সালে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ২০১১ সালের ১২ অক্টোবর স্টেডিয়ামটির নামকরণ করে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপটেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর স্টেডিয়াম। এখানে খেলোয়াড়দের থাকার কক্ষসহ ড্রেসিংরুম রয়েছে। তবে মূল শহর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে স্টেডিয়ামটি। এই কারণে কোনো টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হলেও অধিকাংশ সময় খেলোয়াড় ছাড়া আর কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না গ্যালারিতে।

ক্রীড়াভক্তদের অভিযোগ, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপটেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর স্টেডিয়ামটি শহর থেকে দূরে হওয়ায় সেখানে দর্শকেরা যেতে চান না। শহরের মিনি স্টেডিয়ামটি জরাজীর্ণ থাকায় খেলাধুলা হয় না বললেই চলে। জেলা ক্রীড়া সংস্থার দায়িত্বশীল ভূমিকা না রাখায় প্রতিবছর ফুটবল লিগ অনুষ্ঠিত হয় না। এমনকি ক্রিকেট লিগও হয় অনিয়মিত। মাঠ দুটির দুরবস্থা ও ক্রীড়াঙ্গনের স্থবিরতার কারণে ঝালকাঠি জেলা থেকে ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, কাবাডি, ভলিবলসহ বিভিন্ন খেলায় জাতীয় মানের ভালো কোনো খেলোয়াড় উঠে আসছে না। অনূর্ধ্ব-১৭ বঙ্গবন্ধু কাপ, বঙ্গবন্ধু-বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্ট ও স্কুল-কলেজকেন্দ্রিক টুর্নামেন্ট যা হয়, তাতে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আমেজ না থাকায় জেলার ক্রীড়াঙ্গনই ঝিমিয়ে পড়েছে। এসব টুর্নামেন্টে জেলা ক্রীড়া সংস্থার তেমন কোনো ভূমিকাও থাকে না। 

 গত বুধবার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, বড় স্টেডিয়ামটিতে এলাকাবাসী গরু চরাচ্ছেন। ঘাসে ছেয়ে গেছে মাঠ। খেলার মাঠটি দীর্ঘদিন সংস্কার হয়নি। এতে এই মুহূর্তে খেলার উপযোগিতা নেই মাঠটিতে। খেলাধুলা না থাকায় জেলা ক্রীড়া সংস্থার একজন কর্মচারী পরিবারসহ গ্যালারির নিচতলায় বসবাস শুরু করেছেন। 

একই দিনে মিনি স্টেডিয়ামে গিয়ে দেখা যায়, জরাজীর্ণ গ্যালারিতে কিছু দর্শক শিশু–কিশোরদের ফুটবল খেলা দেখছে। উঁচু–নিচু মাঠে খেলতে পারছে না খুদে খেলোয়াড়েরা। 

শহরের প্রবীণ কয়েকজন ব্যক্তি জানান, আশির দশকে নিয়মিত আয়োজন করা হতো জেলা প্রশাসক (ডিসি) কাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট। ঢাকার নামীদামি ফুটবলাররা আসতেন এখানে। দীর্ঘদিন সেই ডিসি কাপ ফুটবলও হয় না। তারও আগে একসময় জনপ্রিয়তা পেয়েছিল কুমার সত্য ঘোষাল শিল্ড ফুটবল টুর্নামেন্ট। কলকাতার নামী খেলোয়াড়দের এই টুর্নামেন্টে নিয়ে আসতেন সে সময়ের জমিদারেরা। পঞ্চাশের দশকে ঝালকাঠি সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠ ছিল তিনটি। একটিতে হতো হকি। অন্য দুটি মাঠ মুখর থাকত ফুটবলে। কলকাতার খেলোয়াড়েরা সেখানে খেলতে আসতেন নিয়মিত। ঝালকাঠিরও অনেক খেলোয়াড় তখন কলকাতায় যেতেন খেলতে।

গত বছরের ডিসেম্বর মাসে ঝালকাঠি-২ আসনের সাংসদ আমির হোসেন আমুর প্রয়াত স্ত্রী ফিরোজা আমুর নামে ১৬টি দল নিয়ে একটি ফুটবল লিগের আয়োজন করে। এতে চারটি দল সেমিফাইনালে উঠলেও তারপর আর কোনো খেলা মাঠে গড়ায়নি। 

ফিরোজা আমু ফুটবল টুর্নামেন্টে সেমিফাইনালে ওঠা দল ব্রাইট স্টারের স্বত্বাধিকারী গোলাম সরোয়ার বলেন, তাঁর দলকে সেমিফাইনালে তুলতে স্থানীয় ও ঢাকার খেলোয়াড়দের পেছনে প্রায় দেড় লাখ টাকা খরচ হয়েছে। অথচ জেলা ক্রীড়া সংস্থা চূড়ান্ত পর্বের খেলা শেষ করতে গড়িমসি করছে। 

এর আগে সর্বশেষ ফুটবল লিগ হয়েছিল আটটি দল নিয়ে ২০০৮ সালে। সেটাও জেলা ক্রীড়া সংস্থার আয়োজনে। তবে ফিফা আর বাফুফের নির্দেশে সংস্থাটি থেকে আলাদা হয়ে জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন গঠিত হওয়ার পর লিগ হয়নি একটিও। ক্রীড়া সংস্থার কোনো খেলায় স্পনসর নেই বললেই চলে। দেশজুড়ে স্থানীয় হ্যান্ডবল লিগে কিউট কসমেটিকস স্পনসর হিসেবে সহযোগিতা করে। সেই লিগটাও এখন অনিয়মিত।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলার চারটি উপজেলায়ও দীর্ঘদিন ধরে ক্রীড়া সংস্থার কোনো কার্যক্রম নেই। অথচ ক্রিকেট, ফুটবলের পাশাপাশি গ্রামীণ খেলার আয়োজনে একটা সময় সুনাম অর্জন করেছিল ক্রীড়া সংস্থাগুলো। এ বিষয়ে জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক আল মামুন খান বলেন, কিছু সীমাবদ্ধতা ও স্পনসরের সংকটের কারণে নিয়মিত ফুটবল লিগ আয়োজন করা যায় না। তবে জেলা ক্রীড়া সংস্থা ক্রিকেটসহ অন্যান্য খেলাধুলার নিয়মিত আয়োজনের চেষ্টা করে বলে জানান। বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপটেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর স্টেডিয়ামটি দূরে বলে দর্শক না যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন তিনি। 

জেলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মো. জোহর আলী বলেন, খেলাধুলার মান উন্নয়নে সরকার আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিবছর ফুটবলসহ বিভিন্ন টুর্নামেন্ট যাতে নিয়মিত হয়, এখন থেকে সেদিকে দৃষ্টি রাখা হবে। ফিরোজা আমু ফুটবল টুর্নামেন্টের বাকি খেলাগুলোও শিগগির শেষ করা হবে।