তিন সংকটে ধুঁকছে কলেজ

নেত্রকোনা সরকারি কলেজ।  ছবি: প্রথম আলো
নেত্রকোনা সরকারি কলেজ। ছবি: প্রথম আলো

মুকসেতু ইসলাম নেত্রকোনা সরকারি কলেজে গণিত বিভাগের প্রথম বর্ষে পড়েন। তিনি শহরের সাতপাই কেডিসি রোড এলাকায় সহপাঠীদের সঙ্গে মেসে ভাড়ায় থাকেন। তাঁর বাড়ি ময়মনসিংহের ধোবাউড়ায়। পরিবারের আর্থিক সমস্যার মধ্যেও কলেজের আবাসনসংকটের কারণে তাঁকে মেসে থাকতে হয়।

মুকসেতু ইসলাম বললেন, তাঁর বাবা কৃষক। সামান্য জমি চাষাবাদ করে যা আয় হয়, তা দিয়ে আট সদস্যের সংসার চালাতে গিয়ে টানাপোড়েনে পড়েন। ফলে তাঁকে বাধ্য হয়ে টিউশনি করে পড়াশোনার খরচ জোগাড় করতে হয়। তাঁর মেসে থাকা-খাওয়া বাবদই মাসে আড়াই হাজারের বেশি টাকা খরচ হয়। কলেজে আবাসনের ব্যবস্থা থাকলে খরচ কম পড়ত।

নেত্রকোনা সরকারি কলেজে আবাসনসংকটের কারণে অনেক শিক্ষার্থীকেই দূরদুরান্ত থেকে আসা–যাওয়া করতে হয়। এতে খরচ ও সমস্যা—দুটিই আছে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির মোট ২ হাজার ৬৩৪ জন শিক্ষার্থী নিয়ে কলেজে মোট শিক্ষার্থী ১৩ হাজার ১৩২ জন। এর মধ্যে প্রায় ৫৬ শতাংশ ছাত্রী। কিন্তু তাঁদের জন্য দুটি ছাত্রীনিবাসে (শেখ হাসিনা ও বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব) মাত্র ২৩০ জনের থাকার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু ছাত্রদের জন্য থাকার কোনো ব্যবস্থাই নেই। কলেজটিতে নেত্রকোনা জেলা ছাড়াও সুনামঞ্জের ধরমপাশা, মধ্যনগর, ময়মনসিংহের গৌরীপুর, ধোবাউড়া ও কিশোরগঞ্জের কয়েকটি উপজেলার শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা করেন। কলেজটিতে উচ্চমাধ্যমিক ছাড়াও ১৪টি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ও ১৩টি বিষয়ে স্নাতকোত্তরে পড়ানো হয়।

শহরের সাতপাই এলাকায় ৯ দশমিক ৬৫ একর জায়গার ওপর ১৯৪৯ সালে ২৮ জন শিক্ষার্থী নিয়ে কলেজটির যাত্রা শুরু হয়। ১৯৮০ সালে সরকারীকরণ করা হয়। কলেজে অনুমোদিত শিক্ষকের পদ ৬৪টি। এর মধ্যে বর্তমানে ইংরেজি ও রসায়নে একজন করে শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। তবে শিক্ষকেরা বলছেন, কলেজটিতে কমপক্ষে ১৬৩ জন শিক্ষক দরকার। শিক্ষকসংকটের কারণে নিয়মিত ক্লাস করাতে হিমশিম খেতে হয়।

ইংরেজি বিভাগে শিক্ষকের চারটি পদ আছে। কিন্তু কর্মরত তিনজন। এই তিনজন শিক্ষক দিয়ে প্রায় ছয় হাজার শিক্ষার্থীকে পড়াতে হয়। দ্বাদশ শ্রেণির বাণিজ্য শাখার প্রান্ত সরকার, দীপু তালুকদার, নুরে আলম, একাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান শাখার ফারজানা আক্তার, সাদিয়া আক্তারসহ কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, ইংরেজি বিষয়ে তাঁদের বাইরে প্রাইভেট পড়তে হয়।

আবাসন ও শিক্ষকসংকটের পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষও অপ্রতুল। বর্তমানে শ্রেণিকক্ষ আছে ২৮টি। কিন্তু প্রয়োজন ৭৮টি। শ্রেণিকক্ষসংকটের কারণে স্নাতক (সম্মান) একটি বর্ষের ক্লাস চললে অন্য বর্ষের শিক্ষার্থীদের প্রায়ই অপেক্ষায় থাকতে হয়। আবার কোনো কোনো শ্রেণিকক্ষ ছোট হওয়ায় একসঙ্গে সবাইকে পড়ানো সম্ভব হয় না। শ্রেণিকক্ষে ঠিকমতো পড়াশোনা না হওয়ায় সিলেবাস শেষ করতে শিক্ষার্থীরা নোট-গাইড, কোচিং ও প্রাইভেটমুখী হচ্ছেন। কয়েকজন শিক্ষার্থী বললেন, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে নিয়মিত ক্লাস হলেও স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে নিয়মিত ক্লাস হয় না।

অন্যদিকে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার জন্য কলেজে কোনো মিলনায়তন বা মঞ্চ নেই। তারপরও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে। আবার সমস্যার মধ্যেও উচ্চমাধ্যমিকে পাসের হার ৯০ শতাংশ। তবে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৬০ জন। আর স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে সব বিভাগের ফলও তুলনামূলক ভালো।

কলেজটিতে সিসিটিভি ক্যামেরা রয়েছে। সবচেয়ে লক্ষণীয় হলো, প্রতিদিন সকাল সাড়ে আটটা থেকে নয়টা পর্যন্ত কলেজ ক্যাম্পাসে একযোগে দেশাত্মবোধক গান বাজতে থাকে। ঠিক নয়টা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই জাতীয় সংগীত শুরু হয়। এ সময় প্রত্যেকেই নিজ নিজ জায়গায় দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীত গাইতে থাকেন। শুধু তা–ই নয়, প্রতিষ্ঠানটি ধূমপানমুক্ত। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক আরজ আলীর নামে পাঠাগারে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত পড়ার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া কলেজের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের উদ্যোগে গঠিত ফোকলোর পর্ষদ লোকসাহিত্য গবেষণায় অবদানের জন্য ‘চন্দ্র কুমার দে’ লোক গবেষণা পুরস্কার চালু করেছে।

কলেজের অধ্যক্ষ মো. নুরুল বাসেত প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন এই কলেজের স্থান ওপরের দিকে। শ্রেণিকক্ষের কিছু অভাব হলেও কয়েক মাসের মধ্যে তা কেটে যাবে। চলমান তিনটি ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণের কাজ শেষের দিকে। কলেজটিকে প্রান্তিক এবং হাওরাঞ্চলের কলেজ হিসেবে আলাদা বিবেচনা করে ছাত্রাবাস, শিক্ষক, মিলনায়তনের যেসব সংকট রয়েছে, তা সমাধানে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।


● আগামী পর্ব: ফেনী সরকারি কলেজ