কথা-গান-কবিতা-নৃত্যে সিলেটে রবীন্দ্রনাথের আগমনের শতবর্ষ স্মরণ

‘সিলেটে রবীন্দ্রনাথ: শতবর্ষ স্মরণোৎসব পর্ষদ’–এর উদ্যোগে চার দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের উদ্বোধন হয়। ছবি: আনিস মাহমুদ
‘সিলেটে রবীন্দ্রনাথ: শতবর্ষ স্মরণোৎসব পর্ষদ’–এর উদ্যোগে চার দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের উদ্বোধন হয়। ছবি: আনিস মাহমুদ

ঠিক যেন ফিরে এসেছিল সেই ক্ষণ। ১০০ বছর আগের সেই সময়—১৯১৯ সালের ৫ নভেম্বর। সেদিনই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সিলেট শহরে পা রেখেছিলেন। তাঁর সিলেট পরিভ্রমণের শতবর্ষপূর্তি আজ মঙ্গলবার দিনভর ঘটা করেই বর্ণিল আয়োজনে পালন করেছে সিলেটবাসী। অনুষ্ঠানজুড়ে ছিল কবির সৃষ্টিবন্দনা।

আজ বেলা সাড়ে তিনটায় কিনব্রিজ এলাকায় কবিগুরুর ম্যুরাল উন্মোচনের মধ্য দিয়ে ‘সিলেটে রবীন্দ্রনাথ: শতবর্ষ স্মরণোৎসব পর্ষদ’–এর উদ্যোগে চার দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের উদ্বোধন হয়। ম্যুরাল উন্মোচন অনুষ্ঠানের উদ্বোধক ছিলেন আয়োজক পর্ষদের আহ্বায়ক ও সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

ম্যুরাল উন্মোচন অনুষ্ঠানে আয়োজক পর্ষদের সদস্যসচিব ও সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীসহ নগরের বিশিষ্টজনেরা উপস্থিত ছিলেন। সিলেট সফরকালে এই অঞ্চলকে নিয়ে কবিগুরুর লিখিত ‘সুন্দরী শ্রীভূমি’ কবিতাটি ম্যুরালে স্থান পেয়েছে। এরপর পর্ষদের আহ্বায়ক, সদস্যসচিবসহ উপস্থিত সুধীবৃন্দ কেক কাটেন। বিকেল চারটা থেকে চাঁদনিঘাট এলাকায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়। ফাঁকে ফাঁকে চলে সংক্ষিপ্ত আলোচনাও।

সাংস্কৃতিক পর্ব শুরু হয় ১২০ জন নৃত্যশিল্পীর সম্মিলিত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে। দেবাশীষ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ও সুরারোপিত ‘আজি হতে শতবর্ষ আগে তুমি এসেছিলে এই পুণ্যধামে’ গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেন শিল্পীরা। এরপর সিলেটের স্থানীয় শিল্পীরা গান, নৃত্য ও আবৃত্তি পরিবেশনায় অংশ নেন। আলোচনা পর্বে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ প্রমুখ বক্তব্য দেন।

পুরো অনুষ্ঠান সঞ্চালন করেন সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেটের সাধারণ সম্পাদক রজতকান্তি গুপ্ত। অনুষ্ঠানে হাজারো রবীন্দ্র-অনুরাগী উপস্থিত ছিলেন। আয়োজকেরা জানিয়েছেন, চার দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আজ ছিল উদ্বোধনী দিন। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে আলোচনা, সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এসব আয়োজনে দেশ-বিদেশের রবীন্দ্র-গবেষক, মন্ত্রী, শিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা উপস্থিত থাকবেন।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সাবেক সচিব মোফাজ্জল করিম, নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের উপাচার্য আতফুল হাই শিবলী, গণতন্ত্রী পার্টির কেন্দ্রীয় সভাপতি মো. আরশ আলী, যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আহমেদ আল কবির, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী, সহসভাপতি আশফাক আহমদ, সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহীদুল ইসলাম, সিলেট জেলা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আজিজ আহমদ সেলিম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে রবীন্দ্রনাথের স্মরণোৎসব উপলক্ষে আয়োজক পর্ষদের উদ্যোগ নগরজুড়ে দৃষ্টিনন্দন ফেস্টুন, বিলবোর্ড ও ব্যানার সাঁটানো হয়েছে। আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়েছে রবীন্দ্রস্মৃতিধন্য এলাকাগুলোও। তবে এ কাজের অংশ হিসেবে নগরের সুরমা মার্কেট এলাকার নাগরি চত্বর এবং রিকাবিবাজার এলাকার নজরুল চত্বরকে ফেস্টুন ও ব্যানার দিয়ে ঢেকে ফেলার সমালোচনাও করেছেন ঐতিহ্যপ্রেমী নগরবাসী। তবে সমালোচনার মুখে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত নাগরি চত্বর থেকে ফেস্টুন অপসারণের কাজ চলছিল।

সিলেট নগরের কিনব্রিজ এলাকায় কবিগুরুর ম্যুরাল উন্মোচন করেন আয়োজক পর্ষদের আহ্বায়ক ও সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ছবি: আনিস মাহমুদ
সিলেট নগরের কিনব্রিজ এলাকায় কবিগুরুর ম্যুরাল উন্মোচন করেন আয়োজক পর্ষদের আহ্বায়ক ও সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ছবি: আনিস মাহমুদ

সিটি করপোরেশনের শোভাযাত্রা
কবিগুরুর সিলেট আগমনের শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে নগরে শোভাযাত্রা করেছে সিলেট সিটি করপোরেশন। আজ বেলা পৌনে ১১টায় নগর ভবন থেকে এ শোভাযাত্রা বের হয়। এটি নগরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে সিলেট জেলা স্টেডিয়ামে গিয়ে শেষ হয়। শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী।

উদ্বোধকের বক্তৃতায় আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সিলেট আগমনের শতবার্ষিকীর এই অনুষ্ঠান সারা জীবন মানুষের হৃদয়ের স্মরণীয় হয়ে থাকবে। শোভাযাত্রায় সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিধায়ক রায় চৌধুরী, প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. জসীম উদ্দিন, প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলামসহ কাউন্সিলর, কর্মকর্তা, কর্মচারীরা উপস্থিত ছিলেন।

কালকের কর্মসূচি
রবীন্দ্রস্মৃতিবিজড়িত স্থানের মধ্যে এমসি কলেজ অন্যতম। শত বছর আগে কবিগুরু কলেজ ছাত্রাবাসের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে ‘আকাঙ্ক্ষা’ নামে একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। শত বছর পর এমসি কলেজের উদ্যোগে একই দিনে কলেজের উদ্যোগে কাল বুধবার ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও দক্ষিণ এশিয়া’ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে।

কাল সকাল নয়টায় কলেজের বঙ্গবন্ধু ম্যুরালের পাদদেশে শতকণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশন ও জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে কর্মসূচি শুরু হবে। উদ্বোধনী অধিবেশন শেষে দিনব্যাপী সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। এতে দেশ-বিদেশের রবীন্দ্র–গবেষকেরা মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সিলেট পরিভ্রমণকালে নগরের চৌহাট্টা এলাকার সিংহবাড়িতে এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে যোগদান করেছিলেন। রবীন্দ্রস্মৃতিবিজড়িত সেই সিংহবাড়ির উদ্যোগে কাল দিনব্যাপী আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। বেলা আড়াইটা থেকে নগরের মাছিমপুর এলাকার রবীন্দ্রস্মৃতিবিজড়িত মণিপুরিপাড়ায় আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। এ সময় মণিপুরি সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী রাসনৃত্য ও রাখালনৃত্যও পরিবেশিত হবে।

সন্ধ্যা ছয়টায় নগরের পূর্ব জিন্দাবাজার এলাকার গোল্ডেন সিটি কমপ্লেক্সের দোতলায় গ্রন্থবিপণি বাতিঘরের উদ্যোগে ভারতের বিশিষ্ট রবীন্দ্র-গবেষক উষা রঞ্জন ভট্টাচার্য রচিত ‘সিলেটে রবীন্দ্রনাথ: ১৯১৯’ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান হবে।