ওসির 'জনগণের দরবার'

কাঁঠালগাছতলায় মানুষের সমস্যা ও অভিযোগের কথা শুনছেন ঠাকুরগাঁও সদর থানার ওসি। গতকাল ঠাকুরগাঁও সদরে।  ছবি: প্রথম আলো
কাঁঠালগাছতলায় মানুষের সমস্যা ও অভিযোগের কথা শুনছেন ঠাকুরগাঁও সদর থানার ওসি। গতকাল ঠাকুরগাঁও সদরে। ছবি: প্রথম আলো

মূল ফটকের খানিকটা ভেতরে থানা ভবন। প্রবেশপথ পাহারায় দুই পুলিশ সদস্য। তাঁদের পেরিয়ে থানার ভেতরে যাওয়ার সাহস করতে পারলেন না মরিয়ম বেওয়া। আধঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে যাচ্ছিলেন তিনি। ঘটনাটি পর্যবেক্ষণ করছিলেন পুলিশের এক সদস্য। তিনি এগিয়ে গিয়ে মরিয়মকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কাকে চাচ্ছেন আপনি?’ আড়ষ্ট গলায় মরিয়মের উত্তর, ‘ওসি স্যারের কাছে আসছিলাম।’ শুনেই থানার আঙিনায় গাছের নিচের জটলার দিকে ইঙ্গিত করে পুলিশ সদস্য জানালেন, ওসি স্যার ওখানে আছেন।

‘ওসি স্যার গাছতলায় কেন?’ মরিয়মের এমন প্রশ্ন শুনে মুচকি হেসে ওই পুলিশ সদস্য বললেন, ‘দিনের বেলায় স্যার ওখানেই বসেন।’ অবাক মরিয়ম জটলার দিকে এগিয়ে গেলেন। ঠাকুরগাঁও সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আশিকুর রহমান কাছে ডেকে মরিয়মের সমস্যা শুনে পরামর্শ দিলেন। মরিয়ম বললেন, ‘ওসিকে বাইরে না পাইলে আজও হয়তো বাড়ি ফিরে যেতে হতো। সাহস করে থানায় ঢোকা আর হতো না।’

জনগণের আরও কাছাকাছি পুলিশকে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগ নিয়েছেন ঠাকুরগাঁও সদর থানার ওসি আশিকুর রহমান। গত ৩১ অক্টোবর থেকে তিনি দিনে থানার বাইরে বসছেন। সেখানে বিভিন্ন অভিযোগ জানাতে এবং পরামর্শ নিতে পারছেন ভুক্তভোগীরা। আশিকুর বলেন, পুলিশের কাজ হচ্ছে জনগণের সেবা করা, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে পুলিশের কাছে আসতে সাধারণ মানুষের মধ্যে জড়তা কাজ করে। জনগণের আরও কাছাকাছি যাওয়ার লক্ষ্য থেকেই এই উদ্যোগের কথা মাথায় আসে। এখন অনেকে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। খোলামনে সমস্যার কথা জানাচ্ছেন। তিনিও পুলিশ সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।

সম্প্রতি ঠাকুরগাঁও সদর থানায় গিয়ে দেখা যায়, মূল ফটকের ভেতরে খোলা জায়গা পেরিয়ে থানার ভবন। আঙিনায় এক পাশে কাঁঠালগাছের নিচে স্থাপন করা একটি সাইনবোর্ডে লেখা ‘জনগণের দরবার’। সামনে টেবিল-চেয়ার পেতে দরবারে আসা মানুষজনের কথা শুনছেন ওসি আশিকুর। সেখানে এসে ওসিকে কেউ জানাচ্ছেন ব্যক্তিগত অভিযোগ, কেউ বলছেন এলাকার নানা সমস্যার কথা। আবার অনেকে অপরাধমুক্ত এলাকা গড়তে দিচ্ছেন নানা প্রস্তাব। ওসি নিজেই সেসব অভিযোগ শুনে বিষয়গুলো তাৎক্ষণিকই সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

সদর উপজেলার জগন্নাথপুরের বাসিন্দা মোস্তাক আলমের বাড়িতে সম্প্রতি চুরি হয়েছে। তিনি একা থানায় আসতে সাহস পাচ্ছিলেন না। পরে ঠাকুরগাঁও শিল্প ও বণিক সমিতির পরিচালক মামুন-আর-রশিদকে নিয়ে তিনি থানায় আসেন। ওসি তাঁদের কথা শুনে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন। মামুন আর রশিদ বলেন, থানায় আসতে মানুষের যে ভীতি কাজ করত, তা এই উদ্যোগের কারণে দূর হয়ে যাবে।

মহেশপুর গ্রামের আয়েশা বেগম বলেন, ‘আমার একটা মামলা আছে। কিন্তু পুলিশ আসামি ধরে না। তাই ওসি স্যারের কাছে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে আসছিলাম। ওসি স্যার আশ্বস্ত করেছেন, তিনি পুলিশ পাঠাবেন। ওসির সঙ্গে কথা বলার পর স্বস্তি পাচ্ছি।’

যেভাবে শুরু এই উদ্যোগ

২০০৩ সালে পুলিশের উপপরিদর্শক হিসেবে যোগ দেন আশিকুর রহমান। ২০১৩ সালে পরিদর্শক হিসেবে পদোন্নতি পান। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ থানার ওসি হিসেবে যোগ দেন। তারপর কয়েকটি থানা ঘুরে ২০১৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁও সদর থানার ওসি হিসেবে যোগ দেন মোহাম্মদ আশিকুর রহমান। অপরাধ নির্মূলে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ২০১৮ সালে পুলিশ বিভাগ থেকে পুরস্কারও পেয়েছেন।

আশিকুর জানালেন, ২০১৮ সালের অক্টোবরে রংপুরের মিঠাপুকুর থানায় ওসির দায়িত্ব থাকার সময় সেখানে তিনি খোলা আকাশের নিচে দাপ্তরিক কাজ শুরু করেন। বেশ সাড়া পান সেখানে। পরে তিনি ঠাকুরগাঁও সদর থানায় বদলি হয়েছেন।

ওসি বলেন, ঠাকুরগাঁওয়ে আসার পর পুলিশভীতির পুরোনো চিত্র দেখতে পান। অনেকে থানায় ঢুকতে ভয় পান। থানায় এলেও ওসির কক্ষে প্রবেশ করতে সাহস পান না। থানায় একা একা আসতে চান না। আসার সময় রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক, উকিল ধরেন। থানায় ও ওসির কক্ষে ঢুকতে মানুষের ভয় কাটানোর জন্যই তিনি বাইরে বসার পদক্ষেপ নেন। এতে মানুষ জানতে পারবেন, পুলিশ তাঁদের বন্ধু, তাঁদের কল্যাণেই কাজ করে।

ঠাকুরগাঁওয়ের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মুঠোফোনে বলেন, পুলিশ সব সময় জনগণের পাশে থেকে কাজ করে। ওসি আশিকুরের এই উদ্যোগ পুলিশকে জনগণের আরও কাছে নিয়ে যেতে ভূমিকা রাখবে। তাঁর এই উদ্যোগ জেলার অন্য সব থানায় ছড়িয়ে দেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া হবে।