স্লোগান-মিছিল-মহড়া নেই, বিতর্কিতরা বাদ পড়ছেন

কৃষক লীগ
কৃষক লীগ

আওয়ামী লীগের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর জাতীয় সম্মেলন আজ বুধবার থেকে শুরু হচ্ছে। এবারই প্রথম ভিন্ন এক পরিবেশে সংগঠনগুলোর সম্মেলন হতে যাচ্ছে। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের কেন্দ্রীয় কার্যালয় বা ধানমন্ডিতে দলের সভাপতির কার্যালয়কে ঘিরে পদপ্রত্যাশী নেতাদের পক্ষে কর্মী–সমর্থকদের মহড়া নেই। দলীয় কার্যালয়কে ঘিরে সকাল–বিকেল স্লোগান বা মিছিলও হচ্ছে না।

চলমান শুদ্ধি অভিযানের মধ্যে সম্মেলনের আগেই বাদ পড়েছেন যুবলীগের চেয়ারম্যান ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি। আবার স্বেচ্ছাসেক লীগের সাধারণ সম্পাদককেও সম্মেলনের কার্যক্রম থেকে বিরত রাখা হয়েছে। দুটি সংগঠনেই বর্তমান নেতৃত্ব বিতর্কিত হয়ে পড়ায় স্বাভাবিক কারণেই নতুন নেতা সম্মেলনের মধ্যে উঠে আসবেন। তবে কারা নেতৃত্বে আসছেন, সে সম্পর্কে কর্মী–সমর্থকদের মধ্যে স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। এমনকি কী ঘটতে যাচ্ছে সে বিষয়েও কেউ কিছু বলতে পারছেন না।

আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন হবে আগামী ২০-২১ ডিসেম্বর। এর আগে হচ্ছে তিন সহযোগী সংগঠন কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, যুবলীগ এবং ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন শ্রমিক লীগের সম্মেলন হবে। আজ কৃষক লীগের সম্মেলন। মোট পাঁচটি সম্মেলনই হবে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। সব সম্মেলন হবে একই মঞ্চে। তবে সব সংগঠন নিজেদের মতো আলাদা সাজসজ্জা করতে পারবে।

আওয়ামী লীগে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সহযোগী সংগঠন সাতটি। ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন দুটি।

আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, সম্মেলন মানেই দলীয় কার্যালয়ের সামনে পদপ্রত্যাশীদের মহড়া। মোটরসাইকেল নিয়ে শোভাযাত্রা, পোস্টার, বিলবোর্ডের ছড়াছড়ি। এবার এসব দেখা যাচ্ছে না। শুধু দলীয় কার্যালয়ের সামনে পদপ্রত্যাশীদের ভিড় বেড়েছে। ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগের সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ের সামনে বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত ভিড় লেগে থাকছে প্রতিদিন। আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের বাসায় এবং কার্যালয়েও ছুটছেন পদপ্রত্যাশীরা।

সহযোগী সংগঠনগুলোর সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সঙ্গে যুক্ত নেতারা প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন নেতৃত্ব চূড়ান্ত করবেন। সাংগঠনিক নেত্রী হিসেবে কাউন্সিলররা তাঁকে দায়িত্ব দেবেন। কার্যকর ও স্বচ্ছ নেতৃত্ব চূড়ান্ত করতে তিনি ইতিমধ্যেই যাচাই-বাছাই শুরু করেছেন। সব নেতার বিস্তারিত তথ্য তাঁর কাছে আছে। তাই সম্মেলনে শেষ পর্যন্ত ভোটাভুটির প্রয়োজন হবে না। সাংগঠনিক নেত্রীর সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে যোগ্য নেতৃত্ব আসবে বলে আশা করছেন তাঁরা।

কৃষক লীগ
সর্বশেষ ২০১২ সালের ১৯ জুলাই কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলন হয়। এই কমিটির মেয়াদোত্তীর্ণ হয় ২০১৫ সালের জুলাইয়ে। সংগঠনটির বর্তমান নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা সংগঠনে কৃষকদের প্রতিনিধিত্ব করতে ব্যর্থ হয়েছেন। বিশেষ করে রাজধানীর গুলশান, বনানীসহ আবাসিক এলাকার বিভিন্ন ওয়ার্ডেও শাখা কমিটি করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। রাজধানীতে সংগঠনের পদধারী নেতাই আছেন প্রায় ৮ হাজার। যেখানে কৃষক ও কৃষি নেই, সেখানে এই সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। এসব কমিটির নামে বাণিজ্যের অভিযোগও উঠেছে বিভিন্ন সময়। আওয়ামী লীগ নেতারাও এটি নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রশ্ন তুলেছেন।

কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার শামসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বুধবার (আজ) বিকেলে সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে নতুন নেতৃত্বের নাম ঘোষণা করা হতে পারে।

শ্রমিক লীগ
আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন জাতীয় শ্রমিক লীগের সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছিল ২০১২ সালের ১৯ জুলাই। গত সাত বছরে ৪৫টি সাংগঠনিক জেলার কমিটি করা হয়েছে। আগামী ৯ নভেম্বর এ সংগঠনের সম্মেলন। পরিবহনসহ নানা খাতে চাঁদাবাজি, সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে ট্রেড ইউনিয়ন (সিবিএ) নিয়ন্ত্রণ করে নানা অপকর্মের অভিযোগ আছে বর্তমান নেতৃত্বের বিরুদ্ধে। বর্তমান সভাপতি শুক্কুর মাহমুদ একই সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ জেলা শ্রমিক লীগেরও সভাপতির। দুই পদে একসঙ্গে থাকা নিয়ে সংগঠনে সমালোচনা রয়েছে। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরও জনতা ব্যাংক সিবিএ নিয়ন্ত্রণ করছেন কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. সিরাজুল ইসলাম। তাঁদের দুজনের বিরুদ্ধেই অপকর্ম করে বিত্তবৈভব গড়ার অভিযোগ করেছেন সংগঠনের একাধিক নেতা।

শ্রমিক লীগের সভাপতি শুক্কুর মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, দুই পদে থাকা নিয়ে সংগঠনের গঠনতন্ত্রে কোনো বাধা নেই। অনেকে অনেক অভিযোগ তুলতে পারে, তা সত্য নয়। সবকিছু বিচার-বিবেচনা করেই নেত্রী (শেখ হাসিনা) নতুন নেতৃত্ব চূড়ান্ত করবেন।

স্বেচ্ছাসেবক লীগ
২০১২ সালের ১১ জুলাই স্বেচ্ছাসেবক লীগের সর্বশেষ সম্মেলন হয়। এরপর গত সাত বছরে ৭৮টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ৪৫টিতে নতুন কমিটি করা হয়েছে। দলীয় কর্মসূচির জন্য লাখো নেতা তৈরি করা হলেও স্বেচ্ছাসেবী কাজে সংগঠনটি দৃষ্টান্ত দেখাতে পারেনি। ক্যাসিনো–বাণিজ্যে নাম আসার অভিযোগে সংগঠনের সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাওছারকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এরপর সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পংকজ নাথকে সম্মেলনের কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়।

১৬ নভেম্বর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সম্মেলন হবে। এর আগে ১১ ও ১২ নভেম্বর ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের সম্মেলন হবে। সর্বশেষ ১১ বছর আগে হয়েছিল দুই মহানগরের সম্মেলন।

রাজধানীতে স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা আছেন প্রায় আট হাজার। সারা দেশে জেলা, থানা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন মিলে সংগঠনের নেতার সংখ্যা সাড়ে তিন লাখের বেশি।

স্বেচ্ছাসেবক লীগের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক নির্মল রঞ্জন গুহ প্রথম আলোকে বলেন, কেন্দ্রীয় কমিটির প্রায় সবাই ছাত্রলীগ থেকে আসা। সংগঠনে যাঁরা দীর্ঘদিন আছেন, তাঁদের অতীত কর্মকাণ্ড বিবেচনা করেই নতুন নেতৃত্ব চূড়ান্ত করবেন সাংগঠনিক নেত্রী।

আলোচনায় যুবলীগ
যুবলীগের তিন বছরমেয়াদি সর্বশেষ সম্মেলন হয় ২০১২ সালের ১৪ জুলাই। মূলত সংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্বের অনীহার কারণেই নির্ধারিত সময়ের পরও সম্মেলন করা যায়নি বলে জানিয়েছেন কয়েকজন যুবলীগ নেতা। তাঁরা বলেন, গত সাত বছরে নতুন করে ৩৭টি জেলার কমিটি করা হয়েছে। যুবলীগের ৪৭ বছরের ইতিহাসে কোনো জাতীয় সম্মেলনেই ভোটের মাধ্যমে নেতা নির্বাচিত হয়নি।

নানা অভিযোগে যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। সংগঠনের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য চয়ন ইসলামকে আহ্বায়ক ও সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদকে সদস্যসচিব করে কেন্দ্রীয় সম্মেলনের প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া যুবলীগের নেতা নির্বাচনে ৫৫ বছরের বয়সসীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। বয়সের কারণে কেন্দ্রীয় কমিটির প্রায় ৮০ শতাংশ নেতা বাদ পড়তে পারেন।

এ বিষয়ে যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, সম্মেলন সফল করতে প্রস্তুতি কমিটির সঙ্গে ১১টি উপকমিটি কাজ করছে। বয়স বেঁধে দেওয়ায় এবার নিশ্চিতভাবেই নতুন নেতৃত্ব আসছে সংগঠনে।

চলমান অভিযানের প্রথম দিনেই গত ১৮ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার করা হয় ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। এরপর ৬ অক্টোবর গ্রেপ্তার করা হয় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাটকে। বিতর্কিতরা যাতে আগামী কমিটিতে আসতে না পারেন সে জন্য প্রধানমন্ত্রীর নজরদারি চান নেতা-কর্মীরা।

সার্বিক বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হারুন-অর-রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত থাকলে দুর্নীতি করার সুযোগ বেশি থাকে। তাই লাগাম টানা জরুরি ছিল। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়েই প্রধানমন্ত্রী দল গোছানোয় হাত দিয়েছেন। এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সম্মেলনে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির যোগ্য নেতৃত্ব উঠে আসবে বলে আশাবাদী তিনি।