যাঁদের হাত ধরে দলে অনুপ্রবেশ, তাঁদের নাম তালিকায় নেই

আওয়ামী লীগ
আওয়ামী লীগ

জাতীয় সম্মেলন সামনে রেখে দলে অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা করেছে আওয়ামী লীগ। এ নিয়ে দলে বেশ তোড়জোড় চলছে। কিন্তু এসব ‘অনুপ্রবেশকারীদের’ যাঁরা দলে ভিড়িয়েছেন, তাঁদের নাম নেই তালিকায়। দলের বিভিন্ন সূত্রমতে, অনুপ্রবেশকারীদের অধিকাংশই সরকারি দলের স্থানীয় সাংসদের হাত ধরে দলে এসেছেন।

আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টানা প্রায় ১১ বছর ক্ষমতায় থাকায় বিভিন্ন এলাকায় সুযোগসন্ধানী ও বিতর্কিত অনেকেই আওয়ামী লীগে ঢুকেছেন। অনেকে এসেছেন জামায়াতে ইসলামী, বিএনপি ও ফ্রিডম পার্টির মতো দল থেকেও। এর মধ্যে ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর মাঠপর্যায়ে অন্য দল থেকে সরকারি দলে যোগ দেওয়ার প্রবণতা বাড়তে থাকে। বিতর্কিত ব্যক্তিদের সরকারি দলে আনা নিয়ে বিভিন্ন সময় ‘পদ বাণিজ্যের’ অভিযোগ উঠেছিল আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতার বিরুদ্ধে। এমন নেতাদের নামও তালিকায় আনা হয়নি।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ১ নভেম্বর সাংবাদিকদের বলেন, অনুপ্রবেশকারীদের যে তালিকা করা হয়েছে, তাতে দেড় হাজার ব্যক্তির নাম রয়েছে।

এর মধ্যে রংপুর ও বরিশাল বিভাগের তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অধিকাংশ নেতা জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের। এই দুই বিভাগে ৭৮০ জনের নাম আছে। এতে কয়েক শ নাম আছে, যাঁদের দলে কোনো পদ নেই। তাঁদের নামের পাশে কর্মী বা সমর্থক লেখা রয়েছে। এমনকি তাঁদের আগের রাজনৈতিক পরিচয়ের ছকেও বিএনপি বা জামায়াতের কর্মী-সমর্থক উল্লেখ করা হয়েছে। এই তালিকার মধ্যে দিয়ে স্থানীয় পর্যায়ের প্রভাব বিস্তারকারী অনেক অনুপ্রবেশকারীর নাম আড়ালে চলে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা এমন ধারণার কথা বলেছেন।

তালিকায় অনুপ্রবেশকারীর নাম, পিতার নাম, বর্তমান ঠিকানা, মুঠোফোন নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার আগের রাজনৈতিক পরিচয়ও লেখা আছে তালিকায়। আগের সংগঠনে কোন পদে ছিলেন, আওয়ামী লীগে আসার পর কোন পদ পেয়েছেন, তা–ও উল্লেখ করা হয়েছে। অনুপ্রবেশকারী নেতার পরিবারের সদস্যদের রাজনৈতিক পরিচয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবারের সদস্যদের ও নিকটাত্মীয়ের ভূমিকা লেখা আছে বিবরণীতে। এ ছাড়া তাঁদের নামে থাকা মামলার তথ্য এবং আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার পর উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র, কাউন্সিলর, ইউপি চেয়ারম্যান, সদস্য নির্বাচিত হলে সেটাও উল্লেখ করা হয়েছে। তালিকায় অনেকের ক্ষেত্রে তথ্যের ঘাটতি আছে। অনেকের শুধু ডাকনাম বা স্থানীয়ভাবে প্রচলিত নাম লেখা আছে।

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একাধিক নেতা বলেন, কার হাত ধরে অনুপ্রবেশকারী বা বিতর্কিত ব্যক্তিরা দলে এসেছেন, তাঁদের নাম থাকাটা জরুরি ছিল। তাঁরা কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারেন না। সাংসদের হাতে ফুল দিয়ে প্রকাশ্যে মঞ্চে উঠে অনেকেই দলে অনুপ্রবেশ করেছেন। সাংসদদের প্রশ্রয়েই এঁরা নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ড চালিয়েছেন। তাঁদের দাপটের কারণে অনেক ক্ষেত্রে দলীয় নেতা-কর্মীরা কোণঠাসা হয়েছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে নানা কারণে যাঁরা বিতর্কিত, তাঁদের নামের তালিকা করা হয়েছে। এঁদের কোনোভাবেই দলীয় কোনো পদে রাখা যাবে না। যাঁদের হাত ধরে তাঁরা দলে এসেছেন, তাঁদের বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি সহযোগী সংগঠনে অনুপ্রবেশকারীদের বিষয়টিও আলোচনায় ছিল। যুবলীগের কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগরের দুটি কমিটিতে অনেক বিতর্কিত ব্যক্তির অনুপ্রবেশের বিষয়টি ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের পর সামনে এসেছে। কেউ কেউ গ্রেপ্তার হয়েছেন, কয়েকজন আত্মগোপনে আছেন।

এর আগে উপজেলা নির্বাচনে নৌকার বিরোধিতা করায় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে শাস্তি দিতে গত এপ্রিলে একটি তালিকা করে আওয়ামী লীগ। নৌকার প্রার্থীকে হারিয়ে ১৪০টি উপজেলায় জয় পান দলের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীরা। আর ওই বিদ্রোহী প্রার্থীদের প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ ওঠে অনেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও সাংসদের বিরুদ্ধে। দলের বিরুদ্ধে নির্বাচন করা ১৭৭ জন বিদ্রোহী প্রার্থীকে গত সেপ্টেম্বরে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠিয়েছিল কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। অবশ্য তাঁদের দেওয়া জবাবের ভিত্তিতে গত মাসে সাধারণ ক্ষমার সিদ্ধান্ত নেয় দল।

তবে আগামী ২০-২১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন সামনে রেখে দলে ‘শুদ্ধি অভিযান’ অব্যাহত থাকবে বলে দলীয় সূত্র থেকে জানা গেছে। এর অংশ হিসেবে জেলা, উপজেলা, ওয়ার্ড, এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে যাঁরা বিতর্কিত ও অনুপ্রবেশকারী, তাঁরা যাতে ভবিষ্যতে দলের কোনো পদ না পান, সেটি নিশ্চিত করতে কেন্দ্র থেকে আওয়ামী লীগের মাঠপর্যায়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম প্রথম আলোকে বলেন, অনুপ্রবেশকারীদের বেশির ভাগই বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে যুক্ত ও দলের বদনাম সৃষ্টি করছেন। দল টানা ক্ষমতায় থাকার কারণে এই সুযোগটা তাঁরা নিয়েছেন, দলেরও কেউ কেউ এই সুযোগটা করে দিয়েছেন। এখন পরিশুদ্ধ হওয়ার সময় এসেছে। বিতর্কিত ও অনুপ্রবেশকারীদের বাদ দিলে দল শক্তিশালী হবে।