ঘূর্ণিঝড় 'বুলবুলে' মহাবিপৎসংকেত

ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে সাগর উত্তাল রয়েছে। মাছ ধরার বোট ও লাইটার জাহাজ কর্ণফুলী তীরে রাখা হয়েছে। নগরের  ফিশারি ঘাট এলাকায়। চট্টগ্রাম, ০৮ নভেম্বর। ছবি: জুয়েল শীল
ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে সাগর উত্তাল রয়েছে। মাছ ধরার বোট ও লাইটার জাহাজ কর্ণফুলী তীরে রাখা হয়েছে। নগরের ফিশারি ঘাট এলাকায়। চট্টগ্রাম, ০৮ নভেম্বর। ছবি: জুয়েল শীল

দেশের বেশির ভাগ এলাকার কৃষিজমিতে এখন শীতের সবজি। আমন ধানও পাকতে শুরু করছে। এমন সময়ে আবহাওয়া অধিদপ্তর ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’-এর পূর্বাভাস দিয়েছে। এই ঝড়ের উৎপত্তি আন্দামান সাগরে, এটি বঙ্গোপসাগর হয়ে বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসছে। আজ শনিবার সন্ধ্যার পর ঘূর্ণিঝড়টি সুন্দরবন ও পটুয়াখালী উপকূলে আঘাত হানতে পারে। গতকাল শুক্রবার রাতে ঝড়ের গতিবেগ ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছিল। আঘাত হানার সময় এর গতিবেগ ১৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে।

ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ১০ নম্বর আর চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরকে ৯ নম্বর মহাবিপৎসংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।

আবহাওয়াবিদ আবদুল মান্নান আজ শনিবার সকাল সোয়া নয়টায় প্রথম আলোকে এ কথা জানান।

শুধু প্রবল গতি নয়, ঝড়টির সঙ্গে রয়েছে বিশাল এক মেঘমালা। এর প্রভাবে দেশের উপকূলীয় জেলাগুলোয় গতকাল দুপুর থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। রাজধানীসহ দেশের বেশির ভাগ এলাকার আকাশও মেঘে ঢাকা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিও হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড়ের কারণে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৫ থেকে ৭ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস হতে পারে উপকূলীয় এলাকায়। এরই মধ্যে দেশের উপকূলের ১৪টি জেলাকে জলোচ্ছ্বাসের সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে। গতকাল বিকেলের পর অভ্যন্তরীণ সব নৌপথে লঞ্চ-জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দেশের সমুদ্রবন্দরগুলোর সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়।

সাগরে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে সুন্দরবনের দুবলারচরে রোববার থেকে শুরু হতে যাওয়া রাসমেলা বাতিল করেছে বাগেরহাট জেলা প্রশাসন।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক প্রথম আলোকে জানান, ঘূর্ণিঝড়টি শনিবার (আজ) সন্ধ্যার পর বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম করতে পারে। আঘাত হানার সময় এর গতিবেগ ঘণ্টায় ১২০ থেকে ১৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। ঝড়ের সঙ্গে থাকা মেঘমালার জন্য সোমবার পর্যন্ত দেশের উপকূলসহ বেশির ভাগ এলাকায় প্রবল বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে।

ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে উপকূলের সাত জেলা খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, বরগুনা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর ও ভোলায় সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। উপকূলের ১৪টি জেলায় ৫৬ হাজার স্বেচ্ছাসেবককে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এসব জেলার ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে থাকা মানুষকে আজ সকাল থেকে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় নিয়ে আসা হবে বলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় বুলবুল আঘাত হানার ভয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন দেশের কৃষকেরা। দেশের ৫৫ লাখ হেক্টর জমিতে আমন ধান রয়েছে, যার মাত্র ২ শতাংশ পেকেছে। বাকি ধান এক-দুই সপ্তাহের মধ্যে পাকবে। আর দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর মাঠে শীতকালীন সবজি রয়েছে। বিশেষ করে ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, মুলা ও শাক রয়েছে। ঝড়ের সঙ্গে আসা বৃষ্টিতে এসব ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা আছে।

এ ব্যাপারে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আবদুল মুঈদ প্রথম আলোকে বলেন, শীতকালীন সবজির ক্ষেত্রে বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। জমিতে যাতে বৃষ্টির পানি না জমে, সে জন্য নালা তৈরি করতে হবে। আধা পাকা ধান না কাটার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, কোনো এলাকায় সমস্যা বেশি হলে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।

শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আসে নভেম্বরে
পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত করেছিল ১৯৭০ সালে, বাংলাদেশে। ১১ নভেম্বর আঘাত হানা ওই প্রলয়ংকরী ঝড়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও আজকের বাংলাদেশে ৩ থেকে ৫ লাখ মানুষ মারা যায়। আর স্বাধীনতার পর দেশে আঘাত হানা সবচেয়ে মারাত্মক ঝড় সিডর আঘাত হানে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর। ১৯৬০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ৩৬টি ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে ৯টি আঘাত হেনেছে নভেম্বরে। সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি ঝড় আঘাত হেনেছে অবশ্য মে মাসে—১৩ টি।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের কাছে থাকা দেশের ঘূর্ণিঝড়গুলোর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১৯৬০ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে গড়ে দুই বছরে এক থেকে দুটি করে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। ২০০৬ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত সময়কালে গড়ে বছরে একটি করে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানা শুরু করেছে। চলতি বছর বঙ্গোপসাগরে মোট ৯টি গভীর নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে ৭টি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়, যার ৫টি ছিল প্রবল মাত্রার ঘূর্ণিঝড়। অর্থাৎ এসব ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১০০ থেকে ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে। এই ঝড়গুলোর মধ্যে গত ১ মে ঘূর্ণিঝড় ফণী বাংলাদেশে আঘাত হানে। বাকিগুলো চীন, ভারত ও থাইল্যান্ডে আঘাত হানে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্যা ও পানি ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, মূলত বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই বিশ্বজুড়ে ঘূর্ণিঝড়ের পরিমাণ বেড়ে গেছে। সামনের দিনগুলোতে তা আরও বাড়বে। কারণ, সাগরের তাপমাত্রা বাড়লে সেখানে ঝড়ের প্রবণতা বেড়ে যায়।

সরকারের প্রস্তুতি
গতকাল শুক্রবার সরকারি ছুটি থাকলেও জরুরি প্রস্তুতির অংশ হিসেবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে জরুরি সভা হয়। উপকূলীয় জেলাগুলোর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। এ ছাড়া জরুরি ত্রাণসামগ্রী বরাদ্দের পাশাপাশি চাল, ওষুধসহ বিভিন্ন অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রী প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ কামাল প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিটি জেলার জরুরি তহবিল হিসেবে ৫ লাখ টাকা ও প্রয়োজনীয় চাল দেওয়া হয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের ঘূর্ণিঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পূর্বাভাসে বলা হয়, গতকাল রাত ৯টায় ঘূর্ণিঝড়টি পায়রা বন্দর থেকে ৫৭৫ কিলোমিটার, মোংলা থেকে ৫৮৫ কিলোমিটার, কক্সবাজার থেকে ৬৪৫ এবং চট্টগ্রাম থেকে ৬৯৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছিল। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রে বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৭৪ থেকে ১০০ কিলোমিটার, যা ঝোড়ো হাওয়ার বেগে ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সাগর উত্তাল হয়ে উঠেছে।

আবহাওয়াবিদ আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়টি উত্তর-পশ্চিম উপকূলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এটি আরেকটু ডান দিকে ঘুরতে পারে। আমাদের যে পর্যবেক্ষণ, এতে মনে হচ্ছে, ঘূর্ণিঝড়টি খুলনা-বরিশাল উপকূলীয় অঞ্চলের ওপর আঘাত আনবে।’