৯৪ শতাংশ মানুষ বিদ্যুতের আলোয়

পদ্মা নদী থেকে সামান্য দূরে পাবনার সুজানগরের চর রামকান্তপুর। দুর্গম এই চরে যাতায়াতের বড় অংশই মাটির সড়ক। বছর দুই আগেও গ্রামের মানুষের একমাত্র জীবিকা ছিল কৃষি। বিদ্যুৎ ছিল না। সেই চর এখন পাল্টে গেছে। সেখানে এখন ছোট আকারে ধানকল থেকে শুরু করে হাঁস-মুরগির খামার, যন্ত্রচালিত যানে বিদ্যুৎ ব্যবহার হচ্ছে। এতে পাল্টে গেছে চরের হতদরিদ্র মানুষগুলোর জীবন–জীবিকা।

পাবনার শুধু চর রামকান্তপুর নয়, জেলার চর চণ্ডীপুর, দড়িরচর, ঢালচরের মানুষের জীবনে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। এর পেছনে নতুন বিদ্যুৎ–সংযোগ বড় ভূমিকা রেখেছে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ১১ বছরে ২ কোটি ৪৩ লাখ নতুন গ্রাহক বিদ্যুৎ–সংযোগ পেয়েছে। এর ফলে দেশের ৯৪ ভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। বেড়েছে বিদ্যুতের মাথাপিছু ব্যবহারও, যা প্রায় ১৩১ শতাংশ। স্বাধীনতার পর থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত এই হার ছিল ৪৭ শতাংশ।

২০০৯ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর বিদ্যুতের উন্নয়নে ৪০ বছর মেয়াদি একটি মহাপরিকল্পনা (পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান) করে। সেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ নতুন গ্রাহককে সংযোগ দেওয়ার বিস্তারিত পরিকল্পনা করা হয়। আর ২০১৬ সালে নেওয়া হয় ক্রাশ প্রোগ্রাম ‘শেখ হাসিনার উদ্যোগ ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’ প্রকল্প। এ প্রকল্পের আওতায় ২০২১ সালের মধ্যে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার কথা। প্রকল্পটি শেষ হবে ২০২১ সালে। তবে তার এক বছর আগেই দেশের শতভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে যাবে বলে মনে করছেন বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা।

অবশ্য সরকার প্রায় শতভাগ বিদ্যুৎ–সুবিধা নিশ্চিত করলেও এখনো কম দামে ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।

>

দেশের চর, দ্বীপ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বিদ্যুৎ–সুবিধা পৌঁছে যাচ্ছে
এখন চ্যালেঞ্জ সাশ্রয়ী ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ

গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক কাজী সাহাবুদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গ্রামে বিদ্যুৎ যাওয়ার ফলে কৃষি অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। কৃষি উৎপাদনে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার বেড়েছে। এতে নতুন নতুন জীবিকার পথ তৈরি হয়েছে। তবে বিদ্যুৎ–সাশ্রয়ী ও নিরবচ্ছিন্ন হলে তা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে আরও বড় অবদান রাখবে।

১১ বছরে আড়াই কোটি নতুন গ্রাহক

বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালে সারা দেশে বিদ্যুতের গ্রাহক ছিল ১ কোটি ৮ লাখ। গত ১১ বছরে গ্রাহক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৫১ লাখ। এই সময়ে জাতীয় সঞ্চালন লাইনের বাইরে থাকা প্রত্যন্ত গ্রাম ও চরাঞ্চলেও বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে সরকার। এতে মাথাপিছু বিদ্যুতের ব্যবহারও বেড়েছে। আগে উৎপাদন অনুযায়ী বছরে মাথাপিছু বিদ্যুৎ ব্যবহার ছিল ২২০ ইউনিট (কিলোওয়াট প্রতি ঘণ্টা)। বর্তমানে সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫১০ ইউনিটে।

দেশে প্রথমবারের মতো দীর্ঘ ১৫ কিলোমিটার সাগর তলদেশে সাবমেরিন কেব্‌ল স্থাপন করে সন্দ্বীপে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করেছে সরকার। গত বছরের নভেম্বরে দেশের বিচ্ছিন্ন এই সাগরদ্বীপের ঘরে ঘরে জ্বলে উঠে বিদ্যুতের বাতি।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব আহমদ কায়কাউস প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ছিল সারা দেশের মানুষকে বিদ্যুতের সুবিধার আওতায় আনার। ইতিমধ্যে ৯৪ ভাগ মানুষকে বিদ্যুতের সুবিধার আওতায় আনা হয়েছে। তিনি বলেন, আগে গ্রামে হারিকেন ও কুপিতে কেরোসিন তেলের ব্যবহার মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াত। গ্রামে বিদ্যুৎ যাওয়ার কারণে এখন এসব আর নেই।

সৌরবিদ্যুতে আলোকিত ৫৫ লাখ পরিবার

রাজশাহী শহরের নাগরিক সুবিধায় বেড়ে ওঠা শামীমা আক্তার (২৩) এখন থাকেন চর আষাড়িয়াদহ এলাকায়। এটি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার একটি ইউনিয়ন। এর এক দিকে পদ্মা নদী আর বাকি তিন দিক থেকে ভারতীয় সীমান্তঘেরা। রাজশাহী শহর থেকে বিচ্ছিন্ন এই চরে কীভাবে আছেন—এমন প্রশ্ন শুনেই শামীমা হেসে ওঠেন। বলেন, রাজশাহী শহরে যে সুযোগ-সুবিধা আছে, এখানেও তাই-ই আছে। বাসায় টেলিভিশন, ফ্রিজ, ফ্যান চলে। বৈদ্যুতিক চুলায় রান্নাও করা যায়। বাসায় ট্যাপের পানিও পাচ্ছেন। তাহলে থাকতে অসুবিধা কোথায়? খারাপ লাগে না। ভালোই লাগে।

সৌরবিদ্যুৎ এই চরের মানুষের জীবন বদলে দিয়েছে। পাঁচ বছর আগেও কেরোসিন শিখাই ছিল এই ইউনিয়নের মানুষের আলোর একমাত্র ভরসা। চর আষাড়িয়াদহে সৌরবিদ্যুতের আওতায় এসেছে ১ হাজার ৩৫০ জন। বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সৌরবিদ্যুতের প্যানেল স্থাপনের মাধ্যমে এখন দেশে ৫৫ লাখ পরিবার বিদ্যুতের সুবিধায় এসেছে। পৃথিবীতে কোনো দেশে এত সংখ্যক পরিবারে সৌর প্যানেল স্থাপনের নজির নেই। ২০০৯ সালে দেশে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করত ৯৬ হাজার পরিবার।

বিদ্যুৎ যাচ্ছে গ্রাম থেকে গ্রামে

দেশে এখন ৩ কোটি ৫১ লাখ গ্রাহকের বিদ্যুৎ–সংযোগ রয়েছে। এর বড় অংশই গ্রামের। সারা দেশে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে বড় ভূমিকা রেখেছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন উন্নয়ন বোর্ডের (আরইবি) ৮০টি সমিতি। দেশের সব থেকে বড় বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা আরইবির কার্যক্রম রয়েছে ৬১ জেলার ৪৬১টি উপজেলায়। এসব এলাকার ৮৪ হাজার ৮০০ গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১২ সালে। ইতিমধ্যে ৮১ হাজার ৬০৬টি গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে।

বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশে শতভাগ মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার প্রধান চ্যালেঞ্জ দুর্গম চরাঞ্চল ও দ্বীপগুলো। গত ৬ অক্টোবর আরইবির দেওয়া এক হিসাবে বলা হয়েছে, এমন দুর্গম চর ও দ্বীপের ১১৪৬টি গ্রাম তারা চিহ্নিত করেছে। এসব অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হলে নদীর ভেতর বিতরণ খুঁটি স্থাপন (রিভার ক্রসিং) ও নদীর তলদেশ দিয়ে সাবমেরিন কেব্‌ল স্থাপন করতে হবে। এসব গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেলে দেশের কোনো মানুষই আর বিদ্যুতের সুবিধার বাইরে থাকবে না বলে মনে করছে আরইবি।

প্রবৃদ্ধিতে বিদ্যুৎ ভূমিকা রেখেছে

বিআইডিএসের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১০ লাখ ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে তার প্রভাব সামষ্টিক অর্থনীতিতেও পড়ে। এতে অর্থনীতিতে বাড়তি যোগ হয় প্রায় ৪ কোটি ৬০ লাখ থেকে ১০ কোটি ৭০ লাখ টাকা।

পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো গড়ে ৩ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট। বর্তমানে দেশে প্রায় ২০ হাজার মেগাওয়াট স্থাপিত বিদ্যুতের ক্ষমতা রয়েছে।

২০০৯ সালে বিদ্যুতে চালিত সেচ নলকূপ ছিল ২ লাখ ৩৪ হাজার। এখন সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৬৪ হাজার। বিআইডিএসের গবেষণা বলছে, ডিজেলচালিত সেচযন্ত্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ ৪৭ টাকা ১৮ পয়সা। যেখানে সেচের বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি মূল্য ৪ টাকা।

বিআইডিএসের গবেষণা বলছে, ২০১০ সালের আগে দেশে চাল আমদানিতে প্রতিবছর প্রায় ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় হতো, সেচব্যবস্থায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারায় কৃষি উৎপাদন বেড়েছে, এখন চাল আমদানির প্রয়োজন হয় না। এ ছাড়া শিল্প ও ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারার কারণে। বেড়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের পরিমাণ।

চ্যালেঞ্জ সাশ্রয়ী মূল্যে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ

পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় ছিল প্রতি ইউনিট ২ টাকা ৬১ পয়সা। এ ব্যয় এখন ৬ টাকা ২৫ পয়সায় গিয়ে ঠেকেছে। এ সময় বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ১৩৯ শতাংশ।

দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদনের নীতি নেওয়ায় সরকার রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল (ভাড়া ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক) বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে বেসরকারি ব্যবসায়ীদের অনুমতি দিয়েছে। সে কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে বলে অনেকে মনে করেন।

পিডিবির তথ্যমতে, সব থেকে সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ পাওয়া যায় দেশীয় গ্যাসে। এর উৎপাদন ব্যয় ইউনিটপ্রতি মাত্র ২ টাকা ৮০ পয়সা। তবে গ্যাস–সংকটের কারণে দেশে গড়ে ১৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কেন্দ্র বন্ধ থাকে। সরকার গ্যাসের ওপর নির্ভরতা কমাতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে।

সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ পাওয়ার বড় উপায় সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের ওপর জোর দেওয়া। সাগরে তেল-গ্যাস পাওয়া গেলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় কমে যাবে। গত ১০ বছরে এ বিষয়ে তেমন অগ্রগতি হয়নি।

পিডিবির দেওয়া তথ্যমতে, বর্তমানে ২০ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। উৎপাদন হচ্ছে সর্বোচ্চ সাড়ে ১২ হাজার মেগাওয়াট। চাহিদা অনুযায়ী সঞ্চালন ও বিতরণ অবকাঠামো গড়ে তোলা হলে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন করা সম্ভব।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাত্র ১১ বছরে দেশে ৪৭ শতাংশ থেকে ৯৪ শতাংশ মানুষের কাছে আমাদের সরকার বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছে। এটি বিরাট কাজ ছিল। এই বিদ্যুৎ মানুষের জীবনযাত্রা পাল্টে দিয়েছে। তবে সাশ্রয়ী ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ এখনো বড় চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে, এ জন্য সরকার কাজ করছে।’

[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী]