পোষা প্রাণীর সুস্থতার ঠিকানা

চার বছর বয়সী মায়াকে কোলে নিয়ে গায়ে–মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করছিলেন সাভারের হুমায়রা জামান। স্নেহমাখা কণ্ঠে বললেন, ‘ও এত শান্ত, এত ভদ্র!’ মায়ার সমস্যা কী জানতে চাইলে বললেন, ওর নিউরোলজিক্যাল সমস্যা আছে। নিয়মিত ওষুধ খাওয়াতে হয়। তবে দুদিন ধরে কোষ্ঠকাঠিন্য। তাই দেরি না করে হাসপাতালে এসেছেন।

সুন্দ্রীকে শুইয়ে পরীক্ষা করছিলেন একজন চিকিৎসক। পেটের কাছে ফুলে থাকা জায়গায় ধরতেই কঁকিয়ে উঠল সুন্দ্রী। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মিরপুর ১১ নম্বরের বাসিন্দা মিজানুর রহমান উদ্বিগ্ন। তাঁর আদরের সুন্দ্রীর কী হয়েছে সেটা বুঝতে না পারায় উদ্বেগ বাড়ছিল। 

মায়া ও সুন্দ্রীর মতো পোষা প্রাণীর হাসপাতালের চিত্র এটি। মায়া ও সুন্দ্রী দুটোই মেয়ে বিড়াল। তাদের মালিকেরা নির্দিষ্ট ফি পরিশোধ করে সেবা নিচ্ছেন এই হাসপাতাল থেকে।

 হাসপাতালটির পুরো নাম টিচিং অ্যান্ড ট্রেনিং পেট হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার। ‘পেট হসপিটাল’ নামেই পরিচিত। চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস ইউনিভার্সিটির অধীনে রাজধানীর পূর্বাচল নিউটাউনের ১৮ নম্বর সেক্টরে প্লট ৫বি, ১১৪ নম্বর সড়কে গড়ে উঠেছে আধুনিক সুবিধাসমৃদ্ধ পোষা পশুপাখির এই হাসপাতাল। পূর্বাচলের ৩০০ ফুট রাস্তার দুই ধারের সবুজের সমারোহ আর পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলে পাওয়া যাবে হাসপাতালটি। নীলা মার্কেট পেরিয়ে মূল সড়ক থেকে বাঁদিকে নেমে সরু রাস্তা ধরে এগোতে হয়। একাধিক সাইনবোর্ডে হাসপাতালে পৌঁছানোর দিকচিহ্ন রয়েছে।

হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক নীতীশ চন্দ্র দেবনাথ প্রথম আলোকে বলেন, দেশে পশু চিকিৎসাসংক্রান্ত শিক্ষার বেশি গুরুত্ব ছিল খাদ্য উৎপাদনে যুক্ত পশুদের ঘিরে। যেমন– গরু, ছাগল, ভেড়া। এখন নগরায়ণ হচ্ছে, পরিবার ছোট হচ্ছে, মানুষের আয়ু বেড়ে যাচ্ছে। এখন যেসব পশুপাখি পরিবারগুলোকে সঙ্গ দেয় তাদের কদর বেড়েছে। এই হাসপাতালটির লক্ষ্য পশুদের সেবা দেওয়া, স্নাতকদের হাতে-কলমে শিক্ষা দেওয়া, শুধু
পোষা পশুপাখির ওপর স্নাতকোত্তর শিক্ষা চালু করা, গবেষণা করা এবং পোষা প্রাণীদের ব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসা নিয়ে সাধারণ মানুষকে শিক্ষিত করা।

২৬ অক্টোবর হাসপাতালটিতে গিয়ে দেখা গেল, দুর্ঘটনা বা মারামারিজনিত আঘাত, খাওয়ায় অরুচি, অস্ত্রোপচার ও বন্ধ্যাকরণের পর ফলোআপ এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য পশুপ্রেমীরা তাঁদের পোষা পশু-পাখিদের নিয়ে এসেছেন।

পা ভেঙে যাওয়া জেনি নামের এই কুকরটির পা এক্স-রে করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি পূর্বাচলের টিচিং অ্যান্ড ট্রেনিং পেট হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারে।  ছবি: প্রথম আলো
পা ভেঙে যাওয়া জেনি নামের এই কুকরটির পা এক্স-রে করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি পূর্বাচলের টিচিং অ্যান্ড ট্রেনিং পেট হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারে। ছবি: প্রথম আলো

ছয় বছরের জেনি আর দেড় বছরের স্নোবল নামের মেয়ে ও ছেলে কুকুরকে নিয়ে এসেছেন মো. আকাশ নামের এক তরুণ। ক্যান্টনমেন্ট এলাকার একটি বাড়ির ওই দুটি কুকুরকে দেখভাল করেন তিনি। বললেন, জেনি পায়ে আঘাত পেয়েছে। আর স্নোবলের বন্ধ্যাকরণ হয়েছে। ফলোআপের জন্য নিয়ে এসেছেন।

হাসপাতালের উপপ্রধান মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক আবদুল মান্নান বলেন, পেট হাসপাতালে ডিজিটাল এক্স-রে, আল্ট্রাসনোগ্রাম, ভ্যাকসিন দেওয়া, রক্ত পরীক্ষা করা ও অর্থোপেডিক সার্জারির ব্যবস্থা রয়েছে। শ্বাসকষ্ট হলে নেবুলাইজ করা হয়, অক্সিজেন দেওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। কুকুর, বিড়াল, কবুতর, খরগোশ, গিনিপিগ, বানর ইত্যাদি পশু নিয়ে মালিকেরা আসেন হাসপাতালে। সবচেয়ে বেশি আনা হয় বিড়াল। এরপরই কুকুর।

গত বছরের ২৮ অক্টোবর যাত্রা শুরু করার পর এ বছরের ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত চিকিৎসার জন্য হাসপাতালটিতে ৩ হাজার ৯টি পোষা পশুপাখির নিবন্ধন করা হয়েছে।

হাসপাতালটি সম্পর্কে জানতে চাইলে শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পশু বিজ্ঞান ও পশু চিকিৎসা অনুষদের ডিন অধ্যাপক মো. আনোয়ারুল হক বেগ প্রথম আলোকে বলেন, এখন যেভাবে পোষা পশুপাখির সংখ্যা বেড়েছে, তাতে এ ধরনের আধুনিক যন্ত্রপাতির সুবিধা সমৃদ্ধ পৃথক হাসপাতালের প্রয়োজন ছিল। হাসপাতালটি বেশ সুনামের সঙ্গে পরিচালিত হচ্ছে।