আতঙ্কে উপকূলের মানুষ

ঘূর্ণিঝড় বুলবুল থেকে রক্ষা পেতে এলাকার মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে মাইকিং করছেন সিপিবির সদস্যরা। গতকাল দুপুরে খুলনার দাকোপ উপজেলার পানখালি এলালায়।  ছবি: সাদ্দাম হোসেন
ঘূর্ণিঝড় বুলবুল থেকে রক্ষা পেতে এলাকার মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে মাইকিং করছেন সিপিবির সদস্যরা। গতকাল দুপুরে খুলনার দাকোপ উপজেলার পানখালি এলালায়। ছবি: সাদ্দাম হোসেন

নেছার আলী গাজীর বয়স ৮০ বছর। পরিবারের সবাইকে নিয়ে প্রমত্তা খোলপেটুয়া নদী পার হয়ে বুড়িগোয়ালিনীতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হয়েছেন। নদী পার হয়ে উঠবেন দাঁতিনাখালী আশ্রয়ণকেন্দ্রে। তাঁর বাড়ি সাতক্ষীরার শ্যামনগরে সুন্দরবনের বুকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ গাবুরায়।

গতকাল শনিবার সকালে শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, বুড়িগোয়ালিনী, মুন্সিগঞ্জ, কাশিমাড়ি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে কখনো মুষলধারে আবার কখনো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। কখনো মাঝারি ধরনের ঝোড়ো বাতাস আবার কখনো মৃদু বাতাস বইছে। সুন্দরবনসংলগ্ন প্রমত্তা নদী খোলপেটুয়া ও কপোতাক্ষ উত্তাল হয়ে উঠেছে। নদী পারাপার বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের চোখমুখে নেছার আলীর মতো আতঙ্ক।

এর মধ্যে কাজ করছেন পুলিশ, বিজিবি, কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনীর সদস্যরা। পাশাপাশি প্রশাসনের ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির স্বেচ্ছাসেবক সদস্যরা। দ্রুত আশ্রয়কেন্দ্র বা নিরাপদ স্থানে যাওয়ার জন্য মাইকিং চলছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলছে নিরাপদ স্থানে চলে যেতে বলা হচ্ছে।

সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল জানান, ঘূর্ণিঝড় বুলবুল মোকাবিলায় বিশেষ করে শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা এলাকার মানুষজনকে নিরাপদে সরিয়ে নিতে ও তাদের সাহায্য করতে সেনাবাহিনী নামানো হয়েছে। ইতিমধ্যে এক শ সেনা সদস্য কাজ শুরু করেছেন।

গাবুরা ইউনিয়নের ডুমুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, দুই শতাধিক নারী ও শিশু সেখানে আশ্রয় নিয়েছে। ওই কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া কুমকুম জানান, তাঁর ভাবির দেড় মাস আগে বাচ্চা হয়েছে। তাঁকে নিয়ে তিনি দ্রুত চলে এসেছেন। রমেছা খাতুন জানান, তাঁর মেয়ে মল্লিকা সাড়ে আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তাই তাঁকে নিয়ে এসে উঠেছেন এই আশ্রয়কেন্দ্রে।

তবে বুড়িগোয়ালিনী দাঁতিনাখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, বেলা দুইটা পর্যন্ত ১৪-১৫ জন আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানে আশ্রয় নেওয়া নূরজাহান বেগম জানান, ঘরবাড়ি ছেড়ে কেউ আসতে চাচ্ছে না।

বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ভবতোষ মণ্ডল জানান, তাঁরা শুক্রবার থেকে প্রচার–প্রচারণা চালাচ্ছেন। সবাইকে আশ্রয়ণকেন্দ্রে আসার অনুরোধ করা হলেও কেউ আসতে চাচ্ছে না। তিনি বলেন, তাঁর ইউনিয়নের কপোতাক্ষ নদের পূর্বদুর্গাবাটি এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বাঁধের ওপর দিয়ে পানি বইছে। যেকোনো সময় তা ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হতে পারে। এ ছাড়া, কৈখালি, রমজাননগর, কাশিমাড়ি, ঝালাপি, বিড়ালক্ষ্মী এলাকার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। একই কথা বলেন গাবুর ইউপির চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম। তিনি জানান, তাঁর ইউনিয়নের নাপিতখালী, গাগড়ামারি, জেলেখালী, গাবুরা এলাকার বাঁধ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউপির চেয়ারম্যান জাকির হোসেন জানান, উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত কপোতাক্ষ ও খোলপেটুয়া নদীর চাকলা, সুভাদ্রকাটি, হরিশখালী ও হিজলিয়া এলাকায় পাউবোর বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। নদীর পানি বাড়লে এসব বাঁধ ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিভাগ-১–এর নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়ের ও বিভাগ-২–এর নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান জানান, পাউবোর ৮৫৬ কিলোমিটার বাঁধের মধ্যে ৫১ কিলোমিটারের ১২৬টি স্থান ঝুঁকিপূর্ণ। তবে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ২০-২৫টি স্থানে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বাঁধ যাতে ভেঙে না যায় এ জন্য জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। আশাশুনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মীর আলিফ রেজা জানান, শুক্রবার থেকে মাইকিং করা হচ্ছে। ১০৭টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। আগের চেয়ে বৃষ্টি বেড়েছে। বেলা তিনটা পর্যন্ত আশ্রয়কেন্দ্রে ৯ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।

শ্যামনগরের ইউএনও মো. কামরুজ্জামান জানান, গাবুরা ইউনিয়ন থেকে লোকজনকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। কোস্টগার্ড, বিজিবি ও নৌবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কাজ করছেন সিপিপির ১ হাজার ২০০ স্বেচ্ছাসেবক। সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক এস এম হাসান জানান, সুন্দরবনের ভেতর থেকে সব জেলে ও বাওয়ালিদের লোকালয়ে আসার জন্য বলা হয়েছে। বনের ভেতর কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিরাপদ স্থানে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল বলেন, জেলার সব সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। ২৭০টি আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়াও সব স্কুল-কলেজের ভবন খুলে দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। বর্তমানে ৫ লাখ ৪২ হাজার টাকা, ৩১০ মেট্রিক টন চাল ও দুই হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার রয়েছে। এ ছাড়া ২৭ হাজার পানি বিশুদ্ধ করার ট্যাবলেট রয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সেনাবাহিনী নামানো হয়েছে। সন্ধ্যার আগে সেনা সদস্যরা শ্যামনগর ও আশাশুনিতে পৌঁছাবেন। জেলার আশ্রয়ণকেন্দ্রগুলোতে গতকাল বিকেল চারটা পর্যন্ত ১ লাখ ৩৫ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছ।

সাতক্ষীরা-৪ আসনের সাংসদ জগলুল হায়দার বলেন, সরকারের সব ইউনিট কাজ করছে। তবে শ্যামনগরের মানুষ ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে রয়েছে। তারা সহজে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে আসতে চায় না।