ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে জোয়ারের পানিতে ভাসছে চাড়িপাড়া গ্রাম

ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে জোয়ারের পানিতে ভাসছে লালুয়া ইউনিয়নের চাড়িপাড়া গ্রাম। কলাপাড়া, পটুয়াখালী। ছবি: প্রথম আলো
ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে জোয়ারের পানিতে ভাসছে লালুয়া ইউনিয়নের চাড়িপাড়া গ্রাম। কলাপাড়া, পটুয়াখালী। ছবি: প্রথম আলো

ঘরের ভেতর পানি, উঠানে পানি। মানুষ যে রান্না করে খাবে, সে অবস্থা পর্যন্ত নেই। পুরো গ্রামটিই পানির নিচে তলিয়ে আছে। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার লালুয়া ইউনিয়নের চাড়িপাড়া গ্রামের এখন এই অবস্থা।

গ্রামটি রাবনাবাদ নদের পাড়ে অবস্থিত। গ্রামের পাশ দিয়ে একসময় ছিল বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস হলে এই বাঁধটিই এখানকার মানুষজনকে রক্ষা করত। সেই বাঁধটি পুরোপুরি বিলীন হয়ে গেছে। ঘূর্ণিঝড় সিডরের সময় এই বাঁধের ক্ষতি হয়। এরপর কয়েক দফা মেরামত করা হয়। তবে রাবনাবাদ নদের করাল গ্রাসে পুরো বাঁধটিই ধীরে ধীরে ভেঙে বিলীন হয়ে গেছে।

বাঁধ না থাকায় ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’–এর প্রভাবে রাবনাবাদ নদের জোয়ারের পানি অনায়াসে ঢুকে পড়েছে গ্রামটিতে। শনি ও রোববারের দুই দফা জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে চাড়িপাড়া গ্রাম। সামনে জোয়ারের পানিতেও প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের খবর পেয়ে এই গ্রামের প্রায় তিন হাজার মানুষ জানমাল রক্ষায় পাশের তিনটি আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছিল। সেখানে নিরাপদে থাকতে পারলেও জোয়ারের ফলে তাদের বেশ আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

রোববার সরেজমিনে দেখা যায়, বেশ কিছু বাড়িঘর জোয়ারের চাপে ভেঙে গেছে। অনেকের টিনের ঘরের চাল, কারও বারান্দা, রান্নাঘর ও গোয়ালঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপড়ে পড়েছে কিছু গাছপালা। গ্রামে চলাচলের আড়াই কিলোমিটার ইট বিছানো সড়কটি হয়েছে বিধ্বস্ত। পানির চাপে সড়কের ইট, মাটি ভেঙে নেমে গেছে। চাড়িপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি রয়েছে সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে। বিদ্যালয়ের দুটি ভবন রাবনাবাদ নদের ভাঙনের মুখে পড়েছে। যেকোনো সময় ভবন দুটি নদবক্ষে বিলীন হয়ে যেতে পারে।

বিদ্যালয়টির সহকারী শিক্ষক মো. আজিজুর রহমান বলেন, ‘সব সময় শঙ্কার মধ্যে থাকি। এই বুঝি ভেঙে পড়ল ভবন। বড় কষ্টের মধ্যে আমরা শিক্ষাদান করছি।’

লালুয়া ইউনিয়ন পরিষদ সূত্রে জানা যায়, শুধু চাড়িপাড়া গ্রাম নয়। রাবনাবাদ নদের জোয়ারের পানি এই গ্রাম দিয়ে ঢুকে পাশের বানাতিপাড়া, নয়াকাটা, চৌধুরীপাড়া, নাওয়াপাড়া, ছোট পাঁচ নং, বড় পাঁচ নং ও মুন্সীপাড়া গ্রাম পানিতে প্লাবিত হয়েছে। নতুন করে পশুরবুনিয়া গ্রামটিতেও পানি প্রবেশ করেছে।

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. রাকিবুল ইসলাম বলেন, ‘জোয়ারের চাপ বাড়লেই পানিতে ডুবে যায় পুরো গ্রাম। অবস্থা এমন হয়েছে এখন প্রতিনিয়ত পানির সঙ্গেই গ্রামের মানুষকে বসবাস করতে হচ্ছে। মাসের পর মাস পানি আটকে থাকায় এখানের বাসিন্দাদের রোগব্যাধি লেগেই থাকে।’

ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে বিধ্বস্ত হয়েছে গ্রামের বাসিন্দা নূরজাহান বেগমের বসতঘর। বিধ্বস্ত ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন ষাটোর্ধ্ব এই নারী। তাঁর স্বামী তিন বছর আগে মারা গেছেন। ঘূর্ণিঝড়ের কথা শুনে ঘর তালাবদ্ধ করে পাশের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছিলেন নূরজাহান। ঝড় শেষ হলে বাড়ি ফিরে দেখেন তাঁর পুরো ঘরটিই বিধ্বস্ত হয়ে মাটিতে পড়ে আছে।

আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ফিরে ভাঙা ঘর দেখে কী করবেন, তা ভেবে পাচ্ছিলেন না নূরজাহান। কথা বলতে কাছে গেলে চোখের পানি ফেলে তিনি বলেন, ‘ঘরডাই আছেলো সম্বল। অ্যাহন কোম্মে থাকমু? মাথা গোঁজবার কোনো উপায় যে মোর নাই।’

গ্রামের আরেক বাসিন্দা হাসান আকন (২৭)। পেশায় জেলে। শনিবার বিকেলে রাবনাবাদ নদের এক কিনারায় তাঁর নৌকাটি বেঁধে রেখেছিলেন। জোয়ারের তাণ্ডবে তাঁর ছোট নৌকাসহ জাল, নোঙর পানিতে ভেসে গেছে। এতে তাঁর এক লাখ টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

মিঠু হাওলাদার, প্রতিবন্ধী মানসুরা বেগম, ইয়াকুব আলী হাওলাদার, সেলিম হাওলাদার, হানিফ হাওলাদারসহ আরও কয়েকজনের ঘরবাড়ি ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়–পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতি দেখতে গিয়েছিলেন কলাপাড়া উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান শাহিনা পারভীন। তিনি বলেন, ‘আসলেই এখানের মানুষের কষ্টের কোনো শেষ নেই। স্বচক্ষে দেখে নিজের কাছেই খারাপ লাগল। উপজেলা পরিষদ থেকে যত দূর সম্ভব দুর্গত মানুষকে সহযোগিতা করার ব্যবস্থা করা হবে।’ এই গ্রামের মানুষের শুধু ঘরবাড়ি ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে, তা নয়। গ্রামের মানুষজনের হাঁস-মুরগি, ছাগল, মাছ ধরার জাল জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে বলেও জানালেন তিনি।

লালুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত হোসেন বিশ্বাস বলেন, ‘বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ না থাকায় ওই গ্রামটিতে জোয়ারের পানি উঠছে আর নামছে। ফলে মানুষজনের ক্ষতিটা বেশি হয়েছে। ওই এলাকার জানমাল রক্ষায় বাঁধটা করা অত্যন্ত জরুরি। না হলে মানুষজন বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হতেই থাকবে।’

কলাপাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই গ্রামটিসহ পাশের আরও কিছু এলাকা থেকে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ জমি অধিগ্রহণ করে নিয়েছে। যেহেতু ওই এলাকাটি এখন পায়রা বন্দরের, সে কারণে ওখানকার যা কিছু উন্নয়ন করার প্রয়োজন তা পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষই করবে।’