চট্টগ্রামে এনআইডি জালিয়াতি তদন্তে গতি নেই

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

সরকারি কর্মচারীদের গ্রেপ্তারে বিধিনিষেধের কারণে মাঝপথে গতি হারিয়েছে চট্টগ্রামের আলোচিত জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) জালিয়াতির মামলার তদন্ত। গুরুত্বপূর্ণ মামলাটির তদন্ত ও তিন কর্মচারীর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে অন্তত ৩০ কর্মকর্তা–কর্মচারীর নাম এসেছে।

সূত্র জানায়, এনআইডি জালিয়াতির মামলায় এখন পর্যন্ত আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার মধ্যে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদীন, অস্থায়ী ডেটা এন্ট্রি অপারেটর মোস্তফা ফারুক ও ইসি ঢাকার কর্মচারী শাহনূর মিয়া অন্যতম। এই তিনজন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে এনআইডি জালিয়াতে তিনটি চক্রের সন্ধান মিলেছে। কর্মকর্তা–কর্মচারীদের যোগসাজশে এই চক্র তিনটি এনআইডি জালিয়াতি করত বলে অভিযোগ। এর মধ্যে প্রায় ২৫ জন এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন, যাঁরা এই মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

গত ১৬ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কার্যালয়ের অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদীনসহ তিনজনকে গ্রেপ্তারের পর কোতোয়ালি থানায় এই মামলাটি হয়েছিল। ডাবলমুরিং থানা নির্বাচন কর্মকর্তার করা ওই মামলায় জয়নালের পর মোস্তফা ফারুক ও শাহনূরকে গ্রেপ্তার করা হয়।

তদন্ত সূত্রের ভাষ্য, সরকারি কর্মচারী বিধিমালার বাধ্যবাধকতার কারণে অন্য কর্মকর্তা–কর্মচারীদের গ্রেপ্তারে বিলম্ব হচ্ছে।

জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাউন্টার টেররিজমের পরিদর্শক রাজেস বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, মামলার তদন্ত চলছে। আগের চেয়ে একটু গতি কমেছে। কারণ, সরকারি কর্মচারীদের গ্রেপ্তারে কিছু নিয়মকানুন রয়েছে। এসব মেনে এগোনো হচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যে তদন্তে আবার গতি ফিরবে বলে তিনি আশাবাদী।

জানা গেছে, গত ৬ অক্টোবর ইসির কয়েকজন কর্মচারীকে গ্রেপ্তারের অনুমতি চেয়ে আবেদন করে কাউন্টার টেররিজম। ওই আবেদন পুলিশ সদর দপ্তর হয়ে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে যায়। এক মাস পার হলেও এখনো অনুমতিপত্র তদন্ত কর্মকর্তার হাতে আসেনি। তবে অনুমতি পাওয়া গেছে বলে ইসির একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। তবে তা এখনো তদন্তকারী কর্মকর্তার হাতে পৌঁছায়নি।

আদালত ও তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জয়নাল আবেদীন, মোস্তফা ফারুক ও শাহনূরের দেওয়া ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে যাঁদের নাম এসেছে, সেখানে ছয়–সাতজন কর্মকর্তা রয়েছেন। এ ছাড়া বাকিরা কর্মচারী। প্রথমে কর্মচারীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এরপর কর্মকর্তাদের।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজমের উপকমিশনার মো. শহীদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তদন্তকাজ চলছে। আপাতত বলার মতো কিছু নেই। তবে তদন্ত সঠিকভাবে হচ্ছে।

অবৈধ পথে জয়নালদের আয়

অফিস সহায়ক জয়নালের পৈতৃক বাড়ি বাঁশখালী পৌর এলাকার আশকরিয়াপাড়ার ভেতরে। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি বড়। পৌর এলাকায় কয়েক মাস আগে জয়নাল একটি পাঁচতলা ভবন নির্মাণে হাত দেন। এই এলাকায় এটি সবচেয়ে উঁচু ভবন। এনআইডি জালিয়াতির মাধ্যমে জয়নাল এত টাকার মালিক বলে অভিযোগ রয়েছে। ভবনটি নিয়ে গত ১৮ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোতে সরেজমিন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল।

তদন্ত কর্মকর্তা রাজেস বড়ুয়া বলেন, জয়নালরা এনআইডি জালিয়াতি করে অবৈধ অর্থের মালিক হয়েছেন। জয়নাল ও শাহনূরের অনেক আত্মীয়স্বজন ইসিতে কর্মরত।

এনআইডি জালিয়াতি চক্রের সঙ্গে জড়িতরা এভাবে অবৈধ পথে কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন বলে তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান। দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) এনআইডি জালিয়াতিতে জড়িত ইসির কয়েকজন কর্মকর্তা–কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চেয়েছে। জয়নালের বাঁশখালীর নির্মাণাধীন ভবনটি দুদক কর্মকর্তারা এরই মধ্যে পরিদর্শন করেছেন।

পেছনের ঘটনা

গত ২২ আগস্ট লাকী নামের এক নারী চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে এনআইডির স্মার্ট কার্ড তুলতে গেলে কর্মকর্তাদের সন্দেহ হয়। পরে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে ওই নারী রোহিঙ্গা এবং টাকা দিয়ে এনআইডি করিয়েছেন। পরদিন এ ঘটনায় মামলা করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

ওই ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে ধরা পড়ে ইসির ডবলমুরিং থানার অফিস সহায়ক (পিয়ন) জয়নাল আবেদীন একটি ল্যাপটপ চুরি করে নিজ বাসায় বসে টাকার বিনিময়ে বিভিন্নজনকে এনআইডি তৈরি করে দিচ্ছেন।

এরপর মোস্তফা ফারুকও একই প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের এনআইডি তৈরির কাজে নিয়োজিত বলে তথ্য আসে। মূলত ইসির খোয়া যাওয়া ল্যাপটপ ব্যবহার করে এই জালিয়াতির কাজ তাঁরা করতেন।

২০১৪ সালে চন্দনাইশ কার্যালয় থেকে চারটি ল্যাপটপ খোয়া যায়। এ বিষয়ে তখন চন্দনাইশ থানায় একটি মামলা করা হয়। সেই মামলায় পরে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় পুলিশ।