চাঁদা না দিলে গাড়ি চলে না

>

লালবাগ কেল্লার মোড়ে লেগুনা ও অটোরিকশার অবৈধ স্ট্যান্ড।  ছবি: প্রথম আলো
লালবাগ কেল্লার মোড়ে লেগুনা ও অটোরিকশার অবৈধ স্ট্যান্ড। ছবি: প্রথম আলো

কেল্লার মোড় থেকে গুলিস্তান ৩০টি লেগুনা চলে। কামরাঙ্গীরচরের মাতবর বাজারে যায় ৫০টি অটোরিকশা। মাসে চাঁদা ৭ লাখ টাকার বেশি।

লালবাগ কেল্লার মোড় থেকে কামরাঙ্গীরচরের মাতবর বাজারে দিনে গড়ে ২০ বার যাত্রী নিয়ে যাতায়াত করেন অটোরিকশাচালক সাইফুল মোল্লা। এতে দিন শেষে যাত্রী ভাড়া আসে প্রায় ১ হাজার টাকা। কিন্তু ঘরে ফেরার আগে এ থেকে রোজ ২৪০ টাকা লাইনম্যানকে দিতে হয়। গাড়ির মালিককে দিতে হয় ৪০০ টাকা। দিনভর অক্লান্ত পরিশ্রমের পর তাঁর হাতে থাকে মাত্র ৩৬০ টাকা। সাইফুলের অভিযোগ, দিন শেষে তাঁর যা আয় হয়, প্রায় সমপরিমাণ টাকাই লাইনম্যানদের চাঁদা দিতে হয়। এই চাঁদা দিতে না হলে পরিবার নিয়ে বেশ স্বচ্ছন্দে চলতে পারতেন। 

সাইফুল মোল্লার মতো প্রায় ৫০টি অটোরিকশা কেল্লার মোড় থেকে মাতবর বাজারে যাতায়াত করে। প্রতিটি অটোরিকশা থেকেই দিনে ২৪০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। এই হিসাবে দিনে প্রায় ১২ হাজার টাকা চাঁদা ওঠে, মাসে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এ ছাড়া কেল্লার মোড় থেকে গুলিস্তানে যাত্রী নিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করে প্রায় ৩০টি লেগুনা। এসব লেগুনা থেকে দিনে ৪০০ টাকা চাঁদা তোলা হয়। এই হিসাবে এসব লেগুনা থেকেও মাসে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা চাঁদা ওঠে। সব মিলে এই মোড় থেকে মাসে ৭ লাখ টাকার বেশি চাঁদা তোলা হয়।

পরিবহনশ্রমিকদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগের স্থানীয় কিছু নেতা–কর্মী ও পুলিশকে এই চাঁদার ভাগ দিতে হয়। তাঁদের টাকা না দিলে রাস্তায় গাড়ি নিয়ে বের হওয়া যায় না। চাঁদা না দিলে অটোরিকশা ও লেগুনা অবৈধ—এমন নানা অভিযোগে চালকদের হয়রানি করে পুলিশ। আওয়ামী লীগের লোকজন কথা বলার আগেই চালকদের মারধর করেন। তাই বাধ্য হয়ে নির্ধারিত লাইনম্যানের হাতে চাঁদার টাকা দেন তাঁরা। পরে সংশ্লিষ্টদের হাতে টাকা পৌঁছে দেন লাইনম্যানরা। 

লেগুনা ও অটোরিকশাচালকেরা জানান, কেল্লার মোড় থেকে গুলিস্তানে যে লেগুনাগুলো চলাচল করে, এর লাইনম্যান হিসেবে কাজ করেন মামুন মিয়া। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে তিনি প্রতিটি লেগুনা থেকে এই চাঁদা আদায় করেন। এরপর তিনি কোন গাড়ি আগে যাবে, আর কোনটি পরে—তা তদারকি করেন। একইভাবে কেল্লার মোড় থেকে মাতবর বাজার পর্যন্ত লাইনের অটোরিকশা চলাচল তদারকি করেন লাইনম্যান হাফিজ। তাঁরা দুজনই বঙ্গবন্ধু পরিষদের লালবাগ থানার সাবেক সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন মিয়ার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। 

গতকাল মঙ্গলবার বেলা ১১টা। কেল্লার মোড় থেকে গুলিস্তান কোন লেগুনা আগে যাবে, তা তদারক করছিলেন মামুন মিয়া। আলাপকালে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তিনি এই মোড়ে লাইনম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। বিনিময়ে চালকদের কাছ থেকে দিনে ২০ টাকা করে নেন। এর বেশি টাকা নেন না বলে তিনি দাবি করেন। তবে তিনি দেলোয়ার হোসেন মিয়ার লোক বলে পরিচয় দেন। পরে অনেক খোঁজাখুঁজির পরও লাইনম্যান হাফিজকে পাওয়া যায়নি। কোনো চালকের কাছে তাঁর মুঠোফোন নম্বর চাইলে তা তাঁদের কাছে নেই বলে জানান।

পরে দেলোয়ার হোসেন মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, মামুন নামে তিনি কাউকে চেনেন না। এই লেগুনা বা অটোরিকশার চাঁদা তোলার সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পৃক্ততা নেই। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘পৈতৃক সূত্রে আমি অনেক সম্পত্তির মালিক। বাবা আমার জন্য অনেক সম্পদ রেখে গেছেন। এখন আমি প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত নই।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জগন্নাথ সাহা রোডের তিনজন বাসিন্দা বলেন, কেল্লার মোড় থেকে কামরাঙ্গীরচর বা গুলিস্তান উভয় দিকে যাত্রীর চাহিদা রয়েছে। ফলে কেল্লার মোড়ে অবৈধভাবে এই লেগুনা ও অটোরিকশাস্ট্যান্ড গড়ে উঠেছে। কিন্তু এসব যানের কোনো বৈধতা নেই। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দীর্ঘদিন ধরে এসব যানে চাঁদাবাজি চলছে। এর নেপথ্যে বা পরোক্ষভাবে কাজ করছেন দেলোয়ার হোসেন মিয়া। তিনি ঢাকা-৭ আসনের সাংসদ হাজি সেলিমের ঘনিষ্ঠ লোক হিসেবে পরিচিত। তাই এই চাঁদাবাজি কার্যক্রমে কেউ বাধা দিচ্ছে না। এ ছাড়া মাস শেষে এই
টাকার একটি অংশ ভাগ পান লালবাগ থানা-পুলিশের কিছু সদস্য। 

জানতে চাইলে লালবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কে এম আশরাফ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, এই চাঁদাবাজির সঙ্গে থানা-পুলিশের কারও সম্পৃক্ততা নেই। কোনো ব্যক্তির নামে যদি চাঁদা তোলা হয়, তা নজর রাখা হবে। হাতেনাতে ধরতে পারলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।