ত্যাগ আর কাজের স্বীকৃতি পেলেন তাঁরা

সম্মাননা স্মারক হাতে সুপর্ণা দে, সপনেহার বেগম, রত্না চক্রবর্তী, পাইংম্রাউ মার্মার বোন ও ইয়াছমিন আক্তার। গতকাল দুপুরে এলজিইডি ভবনে। ছবি: জুয়েল শীল
সম্মাননা স্মারক হাতে সুপর্ণা দে, সপনেহার বেগম, রত্না চক্রবর্তী, পাইংম্রাউ মার্মার বোন ও ইয়াছমিন আক্তার। গতকাল দুপুরে এলজিইডি ভবনে। ছবি: জুয়েল শীল

দুঃসহ কষ্ট আর যন্ত্রণার কথাটি তিনি চেপে রেখেছিলেন দীর্ঘ ৪৪ বছর। ২০১৫ সালে এসে সেই নীরবতা ভাঙেন রত্না চক্রবর্তী। জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দ্বারা লাঞ্ছিত-নির্যাতিত হওয়ার কথা। কীভাবে ক্যাম্পে আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চলে তাঁর ওপর। এরপর মেলে বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি। কিন্তু এই পড়ন্ত বয়সে এসেও জীবনযুদ্ধটা যেন থামেনি তাঁর। নগরের একটি শপিং মলে ঝাড়ুদারের চাকরি করেন এই বীরাঙ্গনা।

তবে আজ বুধবার পাওয়া এক স্বীকৃতি যেন রত্না চক্রবর্তীকে কিছুটা হলেও আনন্দিত করেছে। ‘নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করেছেন যে নারী’—ক্যাটাগরিতে চট্টগ্রাম বিভাগের সেরা জয়িতা হয়েছেন এই নারী।

চট্টগ্রাম নগরের ষোলোশহরের এলজিইডি ভবন মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত বিভাগীয় জয়িতা সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে রত্না সরকারসহ পাঁচ নারী পাঁচ ক্যাটাগরিতে বিভাগের মধ্যে সেরার সম্মাননা পেয়েছেন। আর সব মিলিয়ে এসব ক্যাটাগরিতে ৫৪ নারীকে সম্মাননা দেওয়া হয়েছে।

অনুষ্ঠানে অনুভূতি জানাতে গিয়ে সেই পুরোনো দিনগুলোর কথা বলতে বলতে গলা ধরে আসছিল রত্না চক্রবর্তীর। পুরো অনুষ্ঠানস্থল জুড়েও তখন নীরবতা। যেন একটি পিন পড়লেও শোনা যাবে।

‘শিক্ষা ও চাকরিক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী’—ক্যাটাগরিতে বিভাগের সেরা হয়েছেন সুপর্ণা দে। তাঁর গল্পটাও যে কাউকে লক্ষ্যে পৌঁছাতে রসদ জোগাবে। ৩৫তম বিসিএসের শেষ লিখিত পরীক্ষার আগের দিন। ওই দিন ভোর সাড়ে চারটায় সুপর্ণা দে’র কোলজুড়ে আসে ছেলে সন্তান। আর সকালেই তাঁকে নিয়ে পরীক্ষার হলে ছুটল অ্যাম্বুলেন্স। সেই অদম্য ইচ্ছে, সাহস আর মনোবলের জোরে ৩৫তম বিসিএসে (প্রাণিসম্পদ) সম্মিলিত মেধা তালিকায় ১১তম হয়েছিলেন তিনি। তবে তাতেই থেমে থাকেননি এই নারী। দুই সন্তানকে সামলে বিসিএস ক্যাডারদের ছয় মাসের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে ৪৬ জনের মধ্যে হন তৃতীয়। সাফল্যর জন্য মালয়েশিয়ার ইউপিএম ইউনিভার্সিটি পুত্রা মালয়েশিয়াতে কর্মশালারও সুযোগ পান বাঁশখালীর জলদির এই নারী। চাকরির ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছেন খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার এই প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত)।

অনুভূতি জানাতে গিয়ে সুপর্ণা দে বললেন, ‘চাকরি একটা পেয়ে গেলাম। কোনোভাবে জীবন পার করে দেব—তা আমি চাই না। যোগ্যতা আর দক্ষতার সবটুকু ঢেলে দিতে চাই চাকরিতে। আর সঙ্গে একজন ভালো মা’ও হতে চাই। তবে পরিবারের সহযোগিতা না পেলে এত দূর আসা হতো না।’

সফল জননী ক্যাটাগরিতে সেরা হয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার সপনেহার বেগম। ষষ্ঠ শ্রেণিতেই থেমে যায় এই নারীর শিক্ষাজীবন। এরপর বিয়ে হয়ে যায় দ্রুত। পড়াশোনা না করা স্বামী অন্যের জমিতে কাজ করতেন। কোনোরকমে চলছিল জীবন। কিন্তু নিজের সন্তানদের পড়ালেখায় কোনো কমতি রাখেননি এই নারী। তাঁর চেষ্টায় পাঁচ সন্তানই আজ প্রতিষ্ঠিত। একজন উপসচিব, আরেকজন আছেন বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে। অন্যদের কেউ শিক্ষক, কেউবা চাকরি করছেন শিপিং করপোরেশনে।

‘অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী’—ক্যাটাগরিতে সেরা হয়েছেন কক্সবাজার পৌরসভার বাসিন্দা ইয়াছমিন আক্তার। জন্মের আগেই বাবাকে হারান এই নারী। ফলে অভাবের সংসারে বেশি দূর পড়াশোনা করা হয়নি। ১৭ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। শ্বশুরবাড়িতেও টানাপোড়েন। তাই একটি ব্যাংক থেকে ৬০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে কেনেন গাভি। বাড়তে থাকে গাভির সংখ্যা। সেখান থেকে ধীরে ধীরে হয়ে যায় ডেইরি ফার্ম। ১৮টি গরু থেকে প্রতিদিন ৫৫-৬০ কেজি দুধ বিক্রি করতেন। মাসে ৬০ হাজার টাকা আয় হয় তাঁর। এরপর অন্য নারীদের জন্য কাজ করার বাসনা থেকে কক্সবাজার পৌরসভার সংরক্ষিত আসনের নারী কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করেন। সেখানেও আসে সাফল্য। জনপ্রতিনিধি হওয়ার পর এখন এলাকার নারীদের জন্যও নানা কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।

‘সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান’ —এই ক্যাটাগরিতে সেরা হয়েছেন পাইংম্রাউ মার্মা। তবে তিনি অসুস্থ থাকায় আসতে পারেননি। তাঁর পক্ষে তাঁর বোন সম্মাননা স্মারক গ্রহণ করেন।

মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উদ্যোগে এবং বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়, চট্টগ্রামের ব্যবস্থাপনায় আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বেগম ফজিলাতুন নেসা। চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুল মান্নানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব কামরুন নাহার, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বদরুন নেছা, নগর মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হাসিনা মহিউদ্দিন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাবরিনা আফরিন মোস্তফা।