জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর ঝুঁকি বেড়েছে ৩৬ শতাংশ

প্রসিদ্ধ জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর ঝুঁকি বেড়েছে প্রায় ৩৬ শতাংশ। প্রচণ্ড তাপে ৬৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষের মধ্যে অসুস্থতার প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। বায়ুদূষণজনিত রোগে দেশে অপরিণত বয়সে মৃত্যুও হচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যঝুঁকি ও মৃত্যু কী পরিমাণ বাড়ছে, তা নিয়ে ল্যানসেট গতকাল ১৩ নভেম্বর একটি বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ৪৩ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনে সুনির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশের ওপর কোনো তথ্য নেই। তবে ল্যানসেট-এর জলবায়ু পরিবর্তন ও স্বাস্থ্যঝুঁকিবিষয়ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা পৃথকভাবে বাংলাদেশবিষয়ক তথ্য পাঠিয়েছে।

ল্যানসেট কর্তৃপক্ষ জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক প্যারিস চুক্তির পর স্বাস্থ্য খাতের বৈশ্বিক পরিস্থিতি ‘ল্যানসেট কাউন্টডাউন’ উদ্যোগের মাধ্যমে নজরদারি করে। নজরদারির সর্বশেষ তথ্য এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও স্বাস্থ্যঝুঁকি, স্বাস্থ্য খাতে অভিযোজন ও পরিকল্পনা, উপশম কর্মকাণ্ড, অর্থনীতি ও অর্থায়ন এবং রাজনৈতিক ও জনসম্পৃক্ততা—এ পাঁচ বিষয়ে ৪১টি সূচকের মাধ্যমে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেছেন বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা। জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গসংস্থাসহ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ৩৫টি একাডেমিক প্রতিষ্ঠান এ প্রতিবেদন তৈরির সঙ্গে জড়িত।

>

জলবায়ুর প্রভাব নিয়ে ল্যানসেট বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। 
জলবায়ুর পরিবর্তন সব বয়সী মানুষের স্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। 
সবচেয়ে খারাপ প্রভাব পড়ছে শিশুদের ওপর।

প্রতিবেদন বলছে, প্রাক্-শিল্পযুগে জন্ম নেওয়া শিশুর চেয়ে আজকে জন্ম নেওয়া শিশুটি ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি তাপ অনুভব করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বৃদ্ধ সব বয়সী মানুষের ওপর। সবচেয়ে খারাপ প্রভাব পড়ছে শিশুদের ওপর। বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস নিচে নামাতে না পারলে আজ জন্ম নেওয়া শিশুর স্বাস্থ্যঝুঁকি আজীবন থাকবে। ১৯৬০ সাল থেকে দেখা যাচ্ছে, খাদ্য উৎপাদন কমছে, যা খাদ্যনিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে রেখেছে। উপকূল এলাকায় ভিবরিও কলেরির জীবাণুর পরিমাণ প্রায় ১০ শতাংশ বেড়েছে। এ জীবাণু ডায়রিয়া সৃষ্টি করে।

বাংলাদেশের পরিস্থিতি
ল্যানসেট বলছে, ২০১৮ সালে সারা বিশ্বে ২২ কোটি মানুষ তীব্র তাপতরঙ্গজনিত (হিটওয়েভ) অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়েছিল। ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সী একজন মানুষ অস্বাভাবিক ও অস্বস্তিকর গরমের মধ্যে দিন কাটালে তিনি আক্রান্ত বলে বিবেচনা করা হয়। একজন ব্যক্তির ক্ষেত্রে একাধিক দিনও হতে পারে। এ পরিস্থিতিতে আর্দ্রতা বেশি থাকে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রচণ্ড গরমে জাপানের প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল। অর্থাৎ দেশটির ৬৫ বছরের ওপরের প্রায় সব মানুষই তাপে ভুগেছিলেন। ভারতে এ সংখ্যা ছিল সাড়ে চার কোটি। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে হিটওয়েভে ৩৪ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল বলে ল্যানসেট-এর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০০০-১৭ সালের মধ্যে ডায়রিয়া ও অপুষ্টিজনিত মৃত্যু উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। কিন্তু এ সময়ে কোনো কোনো অঞ্চলে ডেঙ্গু বেড়েছে।

বাংলাদেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দিয়েছে ল্যানসেট কর্তৃপক্ষ। তারা বলেছে, পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ডেঙ্গুর ঝুঁকি ৩৯ শতাংশ কমেছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ডেঙ্গুর ঝুঁকি বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ডেঙ্গুর ঝুঁকি ৩৬ শতাংশ বেড়েছে।

বৈশ্বিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবজনিত অপরিণত বয়সে মৃত্যু বাড়ছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা কত, তার অনুমিত সংখ্যা পাওয়া যায়নি। তবে ল্যানসেট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২০১৬ সালে শুধু বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে ৬৩ হাজারের বেশি মানুষের অপরিণত বয়সে মৃত্যু হয়েছিল।

স্বাস্থ্যের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিকল্পনা ও গবেষণা) এবং জলবায়ু পরিবর্তন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা ইউনিটের সমন্বয়কারী ইকবাল কবীর। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এটুকু নিশ্চিত বলা যায় যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বেড়েছে, বিশেষ করে মশা ও কীটপতঙ্গবাহিত রোগের ঝুঁকি। তবে সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান পাওয়ার মতো গবেষণার ঘাটতি আছে।

বৈশ্বিক পরিস্থিতি
বৈশ্বিকভাবে ৬৫ বছরে বা তার বেশি বয়সী মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি ১৯৯০ সালের চেয়ে ১০ শতাংশ বেড়েছে। পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর এলাকার কোনো কোনো দেশে তা ৩৭ শতাংশ বেড়েছে। আফ্রিকার দেশগুলোয় ২৮ থেকে থেকে ৩১ শতাংশ বেড়েছে।

তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বৃদ্ধি মানুষের কর্মক্ষমতার ওপর প্রভাব ফেলে। এতে মানুষের উৎপাদন ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। ল্যানসেট বলছে, ২০১৮ সালে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বৈশ্বিকভাবে ৪ হাজার ৫০০ কোটি কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়েছিল।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের কোনো কোনো অঞ্চলে বন্যা বাড়ছে। আবার কোনো কোনো অঞ্চলে খরা দীর্ঘায়িত হচ্ছে। খরা দীর্ঘায়িত হলে পয়োব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ফসল কম হয়, খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা দেখা দেয়, অপুষ্টি বাড়ে। ২০১৮ সালে ব্রাজিলের কিছু এলাকায় ১২ মাসজুড়ে খরা ছিল।

ল্যানসেট তাপমাত্রা কমাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কী উদ্যোগ নিয়েছে, তার কিছু উদাহরণ দিয়েছে। পর্যায়ক্রমে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধসহ বেশ কিছু বৈশ্বিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। তারা স্বাস্থ্য খাতে আরও বিনিয়োগ বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়েছে।