মাগুরায় এক সড়ক দুর্ঘটনায় দুই পরিবার মহাসংকটে

সেনাসদস্য পদে চাকরি করতেন পিকুল মোল্লা (৪৩)। ফলে চাকরিজীবনে তেমন স্ত্রী-সন্তানদের পাশে থাকতে পারেননি। দুই মেয়ের শিশুকাল কীভাবে পেরিয়েছে, বুঝতেই পারেননি। তবে একমাত্র ছেলে আল মাহির ইসলামের (৬) জন্মের পর অবসর মেলে পিকুলের। তাই সারাক্ষণ ছেলেটাকে আগলে রাখতেন। এক সড়ক দুর্ঘটনা সেই বন্ধন ছিঁড়ে দিয়েছে। মাহিরকে করেছে বাবা-হারা। একই সড়ক দুর্ঘটনা মা-হারা করেছে আরেক পরিবারের তিন মেয়েকে। দুটি পরিবারই পড়েছে মহাসংকটে।

পিকুল মোল্লা মাগুরা শহরের স্টেডিয়াম পাড়ার বাসিন্দা। গ্রামের বাড়ি সদর উপজেলার মাঝাইল বগুড়া গ্রামে। গত ১১ অক্টোবর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন পিকুল ও তাঁর সঙ্গে থাকা আর্জিনা বেগম (৪৫)। তিনি শহরের কলেজ পাড়ার বাসিন্দা মিজানুর রহমান স্ত্রী। পেশায় চিকিৎসক মিজানুর সম্পর্কে পিকুলের শ্যালক।

পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, ১১ অক্টোবর দুপুর ১২টার দিকে শহরের বাসা থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে বের হন পিকুল মোল্লা। সঙ্গে ছিলেন শ্যালক মিজানুর রহমানের স্ত্রী আর্জিনা বেগম। তাঁরা মিজানুরের গ্রামের বাড়ি সদর উপজেলার শ্রীরামপুরে যাচ্ছিলেন। শহরতলির আবালপুর এলাকায় মাগুরা-ঝিনাইদহ মহাসড়কে দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। ঢাকাগামী পূর্বাশা পরিবহনের বাসের চাপায় ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান দুজন।

নিহত পিকুলের স্ত্রী রেখা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, বাসা থেকে বের হওয়ার মাত্র ১৫ মিনিটের মাথায় তিনি সড়ক দুর্ঘটনায় পিকুল ও আর্জিনার মৃত্যুর খবর পান। পিকুল সেনাসদস্য ছিলেন। চাকরির কারণে বেশির ভাগ সময় পরিবার ছেড়ে দূরে থেকেছেন। বড় মেয়ে এখন দশম আর ছোট মেয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। তাদের শৈশব কেটেছে বাবার সঙ্গ ছাড়াই। বাবার মৃত্যুর পর তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে।

ছোট ছেলে মাহির তবু কিছুটা সৌভাগ্যবান। জন্ম নিয়েছে পিকুল মোল্লা অবসরে যাওয়ার কিছুদিন আগে। ছেলেকে সারাক্ষণ সঙ্গ দিতেন বাবা। মাহির এখন নার্সারি শ্রেণিতে পড়ে। প্রতিদিনই তার দিন শুরু হতো বাবার ডাক শুনে। ঘুম ভাঙিয়ে মাহিরের দাঁত ব্রাশ করানো, নাশতা করানো। এরপর স্কুলে নিয়ে যাওয়া, নিয়ে আসা। সবই নিজ হাতে করতেন পিকুল। সেসব এখন শুধুই স্মৃতি। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটির মৃত্যুতে চোখে অন্ধকার দেখছেন রেখা।

দুর্ঘটনা ঘিরে কিছু প্রশ্ন
একই অবস্থা নিহত আর্জিনার পরিবারেরও। মা-হারা তিন মেয়েকে নিয়ে বিপাকে পড়েছেন মিজানুর রহমান। এই চিকিৎসক বলেন, একজন চালকের বেপরোয়া গতির কারণে আজ দুটি পরিবার মহাবিপদে। তার চেয়েও হতাশার কথা, ঘটনার এক সপ্তাহের মধ্যে বাসচালক জামিনে ছাড়া পেয়ে গেছেন। আবার আলামত হিসেবে বাসটি হেফাজতে না রেখে মালিককে ফেরত দেওয়া হয়েছে।

আবালপুর নামে যে স্থানে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে, সেখানে সড়কের পাশেই বাড়ি জামাল হোসেনের। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, একটি ইজিবাইক ‘ইউটার্ন’ নিয়ে মাগুরা শহরের দিকে যাচ্ছিল। ঝিনাইদহের দিক থেকে আসছিল ঢাকাগামী পূর্বাশা পরিবহনের বাসটি। প্রথমে ইজিবাইকটিকে ধাক্কা দেয়। এরপর রাস্তার বাঁ দিক ছেড়ে ডান দিক ধরে এগোচ্ছিল। সামনে পড়ে যায় বিপরীতমুখী একটি মোটরসাইকেল। সেটিকে চাপা দেয় বাসটি। বাসের চাকায় আটকে পড়ে মোটরসাইকেল। এ অবস্থায় প্রায় ২০০ মিটার এগিয়ে যায় বাসটি। মেসার্স মনোয়ারা পাম্পের সামনে গিয়ে থামে। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় মোটরসাইকেলের আরোহী পিকুল ও আর্জিনার।

এ ঘটনায় ১১ অক্টোবর রাতে রামনগর হাইওয়ে থানার এটিএসআই সমীর নন্দী মাগুরা সদর থানায় একটি মামলা করেন। এতে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে দুজনের মৃত্যুর অভিযোগ আনা হয়। দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ২৭৯/৩০৪-খ/৪২৭ ধারায় করা মামলাটিতে বাসচালকের নাম অজ্ঞাতনামা উল্লেখ আছে।

আদালত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ১৭ অক্টোবর মাগুরা জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে মামলাটির শুনানি হয়। এদিন মিজানুর রহমান নামের এক ব্যক্তি বাসটির চালক হিসেবে আদালতে হাজিরা দেন। আদালত পুলিশ মিজানুরের জামিনের বিরোধিতা করে। তবে শুনানি শেষে তাঁকে জামিন দেন আদালত। এ ছাড়া বাসটিকে মালিকের জিম্মায় দেওয়া হয়। আদালতের সিদ্ধান্তে বলা হয়, মামলায় উল্লেখিত ধারাগুলো জামিনযোগ্য। আর পুলিশের হেফাজতে থাকলে বাসের ক্ষতি হতে পারে। তাই সেটি মালিকের জিম্মায় দেওয়া হলো।

এসব ঘটনাকে রহস্যজনক বলছেন ভুক্তভোগী পরিবার দুটির সদস্যরা। নিহত আর্জিনার স্বামী মিজানুর রহমান বলেন, ‘একটি বাস রং সাইডে গিয়ে চাপা দিয়ে দুজনকে মেরে ফেলল। এটি তো হত্যা মামলা হওয়া উচিত ছিল। হলো সাধারণ একটি ধারায়। আবার এক সপ্তাহ না যেতেই বাসচালক কীভাবে ছাড়া পেল? বাসটিও তো মামলার একটা আলামত। সেটির ফিটনেস বা অন্যান্য বিষয় ঠিকঠাক ছিল কি না, তা পরীক্ষা করে দেখার দরকার ছিল। তা না করে কীভাবে মালিকের কাছে ফেরত দেওয়া হলো?’

মামলার বাদী সমীর নন্দী অবশ্য দাবি করেছেন, ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা প্রথমে মামলায় অনীহা প্রকাশ করেছিলেন। এ কারণে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ সব সময় চায় অপরাধীর বিচার হোক। আর এখানে সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি যেন হয়, সেই ধারা উল্লেখ করেই মামলা হয়েছে।

মামলাটি প্রথমে তদন্ত করছিলেন রামনগর হাইওয়ে থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সাইদুর রহমান। বর্তমানে তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে আছেন বারোবাজার হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহফুজ রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সম্প্রতি আমরা মামলার কাগজপত্র হাতে পেয়েছি। কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলা বাকি আছে। তা শেষ হলেই আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেব।’ মামলার ধারাটি দুর্বল কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ওসি মাহফুজ বলেন, সম্প্রতি সড়ক পরিবহন আইন চালু হয়েছে। মামলাটির এখন বিচার হবে এই আইনের ১০৫ ধারায়। এই ধারা মোতাবেক আসামির বড় শাস্তি হবে। পাশাপাশি ১০৫ ধারার অধীনে সংঘটিত অপরাধ জামিনযোগ্য নয়।