দুর্বৃত্তদের কোপে শেষ ১২ আমচাষির স্বপ্ন

গুন্ধইল মাঠে বাগানের আম গাছগুলো কেটে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা। পোরশা, নওগাঁ। ছবি: ওমর ফারুক
গুন্ধইল মাঠে বাগানের আম গাছগুলো কেটে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা। পোরশা, নওগাঁ। ছবি: ওমর ফারুক

গবাদিপশু ও স্ত্রীর গয়না বিক্রি করে চার বিঘা জমি বর্গা নিয়ে আমের বাগান গড়ে তুলেছিলেন জামালপুর গ্রামের ফটিক বর্মণ। প্রায় এক কিলোমিটার দূর থেকে বালতি ও কলসিতে করে পানি এনে গাছের গোড়ায় দিয়েছেন তিনি ও তাঁর স্ত্রী। এক বছর ধরে অনেক কষ্টে বাগানের আমগাছগুলো লালন-পালন করেছেন তাঁরা। স্বপ্ন দেখছিলেন বাগানের ফল বিক্রি করে স্বাবলম্বী হওয়ার। কিন্তু রাতের আঁধারে কেটে ফেলা হয়েছে ফটিকের ৮৭০টি গাছ।

শুধু ফটিক বর্মণ নন, তাঁর মতো আরও ১১ জন আমচাষির স্বপ্ন শেষ করে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। নওগাঁর সাপাহার উপজেলার তিলনা ইউনিয়নের জামালপুর ও পোরশা উপজেলার গাঙ্গুরিয়া ইউনিয়নের গুন্ধইল মাঠে ৬০ বিঘা জমির ওপর গড়ে তোলা ১২ জন আমচাষির প্রায় আট হাজার আমগাছ কেটে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা। গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে এ ঘটনা ঘটে। এতে তাঁদের প্রায় কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গাছগুলোর বয়স এক থেকে চার বছর পর্যন্ত। কারা, কী শত্রুতায় এসব গাছ কেটে ফেলল, তা এখন পর্যন্ত জানা যায়নি।

এ ঘটনার খবর পেয়ে গতকাল বুধবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন সাপাহার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহজাহান হোসেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কল্যাণ চৌধুরী ও সাপাহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল হাই। এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত সাপাহার ও পোরশা থানায় কোনো অভিযোগ করা হয়নি।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে ফটিকের স্ত্রী রেখা রানী বলেন, ‘গাছগুলো হামার স্বপ্ন ছিল। গ্রামের এক কিলোমিটার দূরত থ্যাকে বালতি আর কলসত করে হামরা দুইজন (স্বামী-স্ত্রী) পানি ডয়ে অ্যানে গাছগুলোত দিছি। ম্যালা শ্রম দিছি। এক রাতেই হামার সব কষ্টের অর্জন শ্যাষ হয়ে গেল। এখন চোখের জল ছাড়া আর কিছুই নাই।’

ফটিক বর্মণের ভাষ্য, প্রতিবছর বিঘাপ্রতি ১৩ হাজার টাকা চুক্তিতে পোরশার মোফাজ্জলের কাছ থেকে জামালপুর মৌজায় অবস্থিত চার বিঘা জমি ১১ বছরের জন্য বর্গা নেন তিনি। ওই জমিতে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ৮৭০টি আমগাছের চারা লাগান। গত ১১ মাসে এই বাগান করতে তাঁর প্রায় ৩ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। সেটা কিনা মুহূর্তেই ধ্বংস করে দেওয়া হলো।

বৃহস্পতিবার সরেজমিনে দেখা যায়, জামালপুর ও গুন্ধইল মাঠে বেশ কয়েকটি বাগানে পড়ে আছে সারি সারি কাটা আমগাছ। কোনো গাছের গোড়া, আবার কোনোটির মাঝখান থেকে কেটে ফেলা হয়েছে।

ক্ষতিগ্রস্ত আমচাষিরা বলছেন, তাঁদের সঙ্গে কারও ব্যক্তিগত শত্রুতা নেই। যেসব জমি লিজ (বর্গা) নিয়ে তাঁরা বাগান করেছেন, ওই সব জমি নিয়ে কোনো বিরোধ নেই। কারা, কী শত্রুতায় তাঁদের এত বড় ক্ষতি করল, তা তাঁরা বুঝতে পারছেন না।

সাপাহার উপজেলার দোয়াশ গ্রামের রায়হান ইসলাম বলেন, তাঁর ১৮ বিঘা জমির ওপর গড়ে তোলা ৩ হাজার ৩০০টি গাছ কেটে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। তাঁর গাছগুলোর বয়স প্রায় ১১ মাস। গাছ কেটে নষ্ট করে ফেলায় তাঁর প্রায় ১০ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে।

বাগানের আম গাছগুলো কেটে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা। পোরশা, নওগাঁ। ছবি: ওমর ফারুক
বাগানের আম গাছগুলো কেটে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা। পোরশা, নওগাঁ। ছবি: ওমর ফারুক

রায়হান ইসলাম বলেন, ‘মঙ্গলবার বিকেলেও বাগান দেখে গেছি। সব ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু বুধবার সকালে বাগান দেখতে আসার পথে দেখি রাস্তার পাশে একটি বাগানের গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এ দৃশ্য দেখে আমার বুক দুরুদুরু করে ওঠে। দৌড় দিয়ে আমার বাগানে গিয়ে দেখি, সব গাছ কেটে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। ব্যাংক ও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে বাগান করেছিলাম। আম্রপালি জাতের আমগাছ লাগিয়েছিলাম। আশা করেছিলাম, আগামী মৌসুমে বাগানের কিছু গাছ থেকে আম পাব। সেই আম বিক্রি করে ঋণ শোধ ও সংসার চালানোর পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু এখন তো সব শেষ হয়ে গেছে। এই ক্ষতি পুষিয়ে আবার বাগান গড়ে তোলা কষ্টকর হয়ে পড়বে।’

শিংপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মোশাররফ হোসেন নামের আরেক বাগানমালিক বলেন, গুন্ধইল মাঠে সাত বিঘা জমির একটি বাগানে আম্রপালি জাতের আমবাগান ও জামালপুর মাঠে চার বিঘা জমিতে বারি ফোর জাতের একটি বাগান গড়ে তোলেন তিনি। দুটি বাগানে প্রায় ৫৬০টি গাছ কেটে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা। তাঁর গাছগুলোর বয়স চার বছর। তিনি বলেন, ‘গত মঙ্গলবার পত্নীতলা উপজেলার মাটিকাটা এলাকার এক আম ব্যবসায়ীর কাছে পাঁচ বছরের জন্য ২০ লাখ ৩০ হাজার টাকায় বাগান বিক্রি করি। পরদিন সকালেই ওই ব্যবসায়ীর লোকদের বাগানের গাছগুলোতে কীটনাশক ছিটানোর কথা ছিল। কিন্তু ওই দিন রাতেই আমার দুটি বাগানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ গাছ কেটে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা। ওই ব্যবসায়ী এখন আর বাগান নিতে চাইছেন না। তাঁকে সব টাকা ফেরত দিতে হবে।’

ক্ষতিগ্রস্ত বাগানমালিক রবিউল আহমেদ বলেন, ‘আমার ১০ বিঘা জমির বাগানের ১ হাজার ৬০০টি গাছ কেটে ফেলেছে। প্রায় ৬ লাখ টাকা পুঁজি খাটিয়ে বাগানটি দুই বছর ধরে গড়ে তুলেছিলাম। গত বছর কিছু গাছে আম এসেছিল। এবার সব গাছেই আম আসত।’ তিনি আরও বলেন, ‘কারও যদি শত্রুতা থাকে, তাহলে আমার সঙ্গে রয়েছে। কিন্তু গাছ কী দোষ করল, বুঝতে পারছি না।’

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘এভাবে কোনো ফলদ গাছ কেটে ফেলা দুঃখজনক। পোরশা ও সাপাহার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের আর্থিক সহায়তার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এ বিষয়ে সাপাহার থানার ওসি আবদুল হাই বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত বাগানগুলো সাপাহার ও পোরশা উভয় উপজেলায় অবস্থিত। বুধবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বাগানমালিকদের সাপাহার ও পোরশা উভয় থানাতেই অভিযোগ দায়ের করতে বলা হয়েছে। কিন্তু আজ (বৃহস্পতিবার) বিকেল পর্যন্ত কেউ কোনো অভিযোগ করেননি। তবে বাগানমালিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা জানান, মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আজ সন্ধ্যা কিংবা আগামীকাল (শুক্রবার) তাঁরা অভিযোগ করতে পারেন। তিনি বলেন, ‘প্রাথমিক তদন্তে বোঝা যাচ্ছে, জমি কিংবা পূর্বশত্রুতার জেরে এ ঘটনা ঘটেনি। ওই বাগানমালিকদের আর্থিক ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে একটি চক্র এ ঘটনা ঘটিয়েছে। অভিযোগ পাওয়া না গেলেও ইতিমধ্যে এ ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে। আশা করছি, খুব শিগগির এ ঘটনার রহস্য উদ্‌ঘাটন করে দুর্বৃত্তদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে।’