রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে জাতিসংঘে প্রস্তাব পাস

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে ওআইসি ও ইইউর নেওয়া প্রস্তাব গতকাল বৃহস্পতিবার পাস হয়। ছবি: জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে ওআইসি ও ইইউর নেওয়া প্রস্তাব গতকাল বৃহস্পতিবার পাস হয়। ছবি: জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন

রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার সুরক্ষা নিশ্চিত আর রাখাইনে তাদের ফেরাটা টেকসই করতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নেওয়া প্রস্তাব গতকাল বৃহস্পতিবার পাস হয়েছে। প্রস্তাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর যে নৃশংসতা হয়েছে, এর জবাবদিহি নিশ্চিত করতে নিরাপত্তা পরিষদকে অব্যাহতভাবে বলার জন্য প্রস্তাবটিতে জাতিসংঘ মহাসচিবকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় অনুযায়ী গতকাল বৃহস্পতিবার ‘মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ শীর্ষক প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। প্রস্তাবের ২০ দফার সুপারিশে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আলোকপাত করে সমাধানের জন্য মিয়ানমারকে কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে, তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। নিউইয়র্ক থেকে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

গতকালের প্রস্তাবটিতে নিরাপত্তা পরিষদকে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে সুস্পষ্ট পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। এতে এটি নিরাপত্তা পরিষদের ওপর সরাসরি চাপ সৃষ্টি করবে। তা ছাড়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যর্থতার জন্য এতে মিয়ানমারকে দায়ী করে জোরালো রাজনৈতিক সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ও প্রত্যাবাসনের উপযোগী পরিবেশ তৈরিসহ সুনির্দিষ্ট ১০টি বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। এর পাশাপাশি জাতিসংঘ মহাসচিবের মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ দূতকে মাঠের পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রতিবেদন উপস্থাপন বাধ্যতামূলক করার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।

গতকালের প্রস্তাবের পক্ষে ১৪০টি ও বিপক্ষে ৯ টি দেশের ভোট পড়েছে। আর ৩২টি দেশ ভোট দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে।

জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেন প্রস্তাবে সদস্য দেশগুলোকে সমর্থনের আহ্বান জানান। ছবি: জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন
জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেন প্রস্তাবে সদস্য দেশগুলোকে সমর্থনের আহ্বান জানান। ছবি: জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন

তৃতীয় কমিটিতে গৃহীত এই রেজল্যুশন ডিসেম্বর মাসে সাধারণ পরিষদের মূল অধিবেশনে আলোচনার জন্য উপস্থাপন করা হবে। ওআইসি ও ইইউর পক্ষে প্রস্তাবটি এবার উপস্থাপন করে যথাক্রমে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ফিনল্যান্ড।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা ঢলের পর থেকেই ওই বছর থেকে নিয়মিতভাবে ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) নেতৃত্বে মিয়ানমারের মানবাধিকার সংকট নিয়ে তৃতীয় কমিটিতে ওই প্রস্তাব আনা হচ্ছে। ২০১৮ সাল থেকে ওআইসি ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) যৌথভাবে তৃতীয় কমিটিতে প্রস্তাবটি তুলছে এবং প্রতিবারই বিপুল ভোটে তা গৃহীত হচ্ছে। এবারের প্রস্তাবটি মিয়ানমারের ওপর রাজনৈতিক চাপকে শুধু জোরদারই করবে না, বরং তা অব্যাহত রাখতে ভূমিকা রাখবে। ওআইসি ও ইইউর সদস্য রাষ্ট্র এবং যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, মেক্সিকোসহ মোট ১০২টি দেশ প্রস্তাবটি কো-স্পনসর করে এবং বিপুল ভোটে তা গৃহীত হয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবারের সাধারণ পরিষদ অধিবেশনে প্রদত্ত বক্তব্যে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে বেশ কিছু প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তৃতীয় কমিটিতে পাস হওয়া গতকালের প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রীর কিছু সুপারিশ স্থান পেয়েছে। এবারের গৃহীত প্রস্তাবে ‘রোহিঙ্গা মুসলিম’ শব্দটির অন্তর্ভুক্তও তাৎপর্যপূর্ণ।

প্রস্তাবের পক্ষে ১৪০টি ও বিপক্ষে ৯টি দেশের ভোট পড়েছে। ছবি: জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন
প্রস্তাবের পক্ষে ১৪০টি ও বিপক্ষে ৯টি দেশের ভোট পড়েছে। ছবি: জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন

প্রস্তাব নিয়ে ভোটাভুটির আগে এর যৌক্তিকতা নিয়ে বক্তব্য দেন ফিনল্যান্ড (ইইউ), কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক, সৌদি আরব ও সুইজারল্যান্ডের প্রতিনিধিরা। ভোট গ্রহণের আগে ও পরে দেওয়া বক্তব্যে প্রায় সব সদস্য দেশের প্রতিনিধি বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার সুরক্ষা, টেকসই পুনর্বাসন, জাতিগত নিধন ও গণহত্যার মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ, সহিংসতার দায় নিরূপণ ও অপধারীদের বিচারের মুখোমুখি করা এবং রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়াসহ মিয়ানমারে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রস্তাবটি তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে গৃহীত বৈশ্বিক পদক্ষেপের মধ্যে এটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ বলেও মন্তব্য করেন তাঁরা। তা ছাড়া প্রস্তাবটি সংকট সমাধানে অন্য অংশীজনদের উৎসাহিত করবে এবং যেসব দেশ এখনো এতে নেতিবাচক ভোট দিচ্ছে, তাদের নৈতিক চাপের মধ্যে ফেলবে বলেও মন্তব্য করেন এসব কূটনীতিক। তাঁরা সবাই বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দান ও অব্যাহতভাবে মানবিক সহায়তা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের ভূয়সী প্রশংসা করেন।

প্রস্তাবের ২০ দফার সুপারিশ রয়েছে। ছবি: জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন
প্রস্তাবের ২০ দফার সুপারিশ রয়েছে। ছবি: জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন

জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেন প্রস্তাবে সদস্য দেশগুলোকে সমর্থনের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘এটিকে আমরা শুধু একটি দেশভিত্তিক প্রস্তাব হিসেবেই দেখছি না, এটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য একটি দায়বদ্ধতার দলিল, যার মাধ্যমে নিশ্চিত হতে পারে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসন।’ সমস্যা সমাধানে তিনি দ্বিপক্ষীয় পদক্ষেপের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক প্রয়াসের গুরুত্ব তুলে ধরেন।

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলা ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) রোহিঙ্গাদের ওপর মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্তের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন মাসুদ বিন মোমেন। তিনি বলেন, এ পদক্ষেপগুলো নৃশংস অপরাধের জন্য দায়ী প্রকৃত দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করতে ভূমিকা রাখবে।