জলে ভাসা জীবনের দুঃখগাথা

ভাসমান নৌকায় মানুষের বসবাস। গাজীপুরের টঙ্গীর তুরাগ পাড়ে সম্প্রতি তোলা।  প্রথম আলো
ভাসমান নৌকায় মানুষের বসবাস। গাজীপুরের টঙ্গীর তুরাগ পাড়ে সম্প্রতি তোলা। প্রথম আলো

‘জলে ভাসা পদ্মে’র মতোই জীবন রাশিদা বেগমের। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে আশ্রয় নিয়েছিলেন তুরাগ নদের পাড়ে একটি ছোট্ট নৌকায়। কিন্তু রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে জীবন যখন বিপন্ন, ঠিক তখন ঘর তুলে ঠাঁই পেয়েছিলেন নদীতীরবর্তী সরকারি জায়গায়। কিন্তু কিছুদিন যেতেই সরকারি উচ্ছেদে ভাঙা পড়ে সেই ঘর। এরপর ঘর তোলেন অন্য আরেকটি জায়গায়। সেখানেও উচ্ছেদ হয়, ভাঙা পড়ে ঘর। এভাবে তিন-চারবার ঘর ভাঙার পর কোথাও ঠাঁই না পেয়ে ফিরে আসেন নৌকায়।

রাশিদার মতো এমন ৭০ থেকে ৮০টি ভাসমান পরিবারের অবস্থান গাজীপুরের টঙ্গী সেতুসংলগ্ন সান্দারপাড়া এলাকায়। তুরাগ নদের পাড়ে ভাসমান নৌকায় গড়ে উঠেছে এসব পরিবার। প্রতিটিই ভূমিহীন। একমাত্র ঠাঁই কেবল চার তক্তার নৌকা।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডের  তুরাগ নদের পাড়ে প্রায় আধা কিলোমিটার জায়গাজুড়ে এই জনগোষ্ঠীর বসবাস। প্রতিটি পরিবার ভূমিহীন। জীবিকা চলে মালামাল ফেরি করে, সড়কে ঝাড়ু দিয়ে বা বাজারে কামলা দিয়ে। এ ছাড়াও অনেকের জীবন চলে নদীতে মাছ ধরে ও বোতল কুড়িয়ে।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী সেতুর নিচ থেকে ওয়াকওয়ের পাশ ঘেঁষে তুরাগ নদের পাড়ে গড়ে উঠেছে এ ভাসমান জনবসতি। শিল্পকারখানার বর্জ্যমিশ্রিত তুরাগের কালো পানির ওপর গাদাগাদি করে ভাসছে অসংখ্য নৌকা। এগুলোর প্রতিটিতে একেকটি পরিবারের বসবাস। প্রতিটি পরিবারে সদস্য চার থেকে পাঁচজন। গাদাগাদি করে থাকে নৌকায়। চলাচলের জন্য নৌকা ও ওয়াকওয়ের মধ্যে বাঁশের সিঁড়ি যুক্ত করা হয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে চলাচল করছে শিশু, কিশোর, বয়স্ক, বৃদ্ধ—সব বয়সের মানুষ। ওয়াকওয়ের হাতলে স্থাপন করা হয়েছে তিন থেকে চারটি পানির ট্যাব। এগুলোর কোনোটি সচল, কোনোটি নষ্ট। পানি নিতে এসে বেঁধে যাচ্ছে লম্বা লাইন। দু-তিনটি শৌচাগার আছে। তবে সেগুলো বেহাল। শৌচকার্য সম্পাদন করতে গিয়ে প্রায়ই বাগ্‌বিতণ্ডা বেধে যাচ্ছে তাদের মধ্যে।

সম্প্রতি একটি নৌকায় রাতের খাবার রান্না করছেন ববিতা বেগম। সন্ধ্যা হতে তখনো দুই ঘণ্টার বেশি বাকি। এত আগে কেন রান্না বসিয়েছেন, জানতে চাইলে তাঁর সহজ স্বীকারোক্তি, ‘সন্ধ্যায় মেয়ে পড়তে বসবে। তার কুপি লাগে। আবার আমি রান্না করতে গেলেও কুপি লাগব। দুই কুপি জ্বালানোর সামর্থ্য নাই।’ অন্যদিকে সকাল-দুপুর-রাত কোনো রান্নাই হয়নি শিউলি আক্তারের ঘরে। আগের রাতে নৌকা ভেঙে যাওয়ায় নির্ঘুম রাত কেটেছে তাঁর। এরপর সারা দিন বাঁশ ও কলাগাছ দিয়ে নৌকা মেরামতের কাজ শেষ করেছেন। তিনি বলেন, ‘টাকাপয়সাও নাই যে ভালো করে নৌকাটা ঠিক করব। সারা দিন শেষে মাত্র রান্না বসাইছি।’

নৌকায় ভাসমান এ জনগোষ্ঠীর আদি অবস্থান সম্পর্কে কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে একাধিক স্থানীয় বাসিন্দা জানান,  প্রায় দেড় বছর আগে থেকেই এখানে বসবাস শুরু হয়েছে তাঁদের। তাঁরা মূলত পেশায় সওদাগর। বিভিন্ন এলাকায় মালামাল ফেরি করে বিক্রি করেন। এ কারণে সওদাগর নাম থেকে ভাসমান এ পাড়ার নামও হয়েছে সান্দারপাড়া। বিভিন্ন এলাকার ভূমিহীনরা এখানে আশ্রয় নিয়ে বসবাস শুরু করে। দুই বছর আগেও এ পাড়ায় পরিবারের সংখ্যা ছিল তিন শতাধিক। কিন্তু অভাব-অনটন আর কষ্ট সহ্য করতে না পেরে অনেকেই চলে গেছে বলে জানিয়েছেন একাধিক বাসিন্দা।

৫৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর গিয়াসউদ্দিন সরকার বলেন, ‘আমি নির্বাচিত হওয়ার পর তাদের জন্য খাওয়ার পানি, পাকা পায়খানাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা করে দিয়েছি। নদীর পাড়ে তাদের ঘর ছিল। বিআইডব্লিউটিএর উচ্ছেদে এসব ঘর ভাঙা পড়ায় বেশি বেকায়দায় পড়েছে তারা। বর্তমানে তাদের অবস্থা খুবই  সংকটাপন্ন।’