নতুন পরিবহন আইন কার্যকরে মাঠে ভ্রাম্যমাণ আদালত

সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ কার্যকরের জন্য আজ সোমবার থেকে মাঠে নেমেছেন বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত। আইন সম্পর্কে কেউ কেউ জানলেও অনেক বাসচালকের অভিযোগ, কাগজপত্র না থাকলেও মালিক সড়কে নামতে তাঁদের নিষেধ করেননি। এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানে গণপরিবহন, পথচারী পারাপারের চিত্র তেমন বদলায়নি। বাসগুলোয় ধরা পড়েছে চিরাচরিত সব অনিয়ম।

১ নভেম্বর নতুন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর করে সরকার। তবে নতুন আইনে মামলা ও শাস্তি দেওয়ার কার্যক্রম মৌখিকভাবে দুই সপ্তাহ পিছিয়ে দেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী। গত বৃহস্পতিবার সেই সময়সীমা শেষ হয়েছে। গতকাল রোববার সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, গতকাল থেকেই আইন কার্যকর শুরু হয়েছে। তবে আজ মাঠে নামেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।

প্রথম দিন রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে জাতীয় সংসদের দিকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারাহ সাদিয়া তাজনীন। দুপুর ১২টার দিকে পুলিশ বিভিন্ন পরিবহনের সাতটি বাস থামায়। দুপুরে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারাহ প্রথম আলোকে বলেন, একটি বাসকে জরিমানা করা হয়নি। এর বাইরেও বাসের ভেতরে ভাড়ার তালিকা না রাখা, হাইড্রোলিক হর্ন থাকা, নারীদের জন্য আসন বরাদ্দ না রাখার মতো অপরাধে জরিমানা করা হয়েছে।

রাজধানীর কাকলী বাসস্ট্যান্ডের পাশে বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত-৪ বসেছেন। ছবি: সুহাদা আফরিন
রাজধানীর কাকলী বাসস্ট্যান্ডের পাশে বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত-৪ বসেছেন। ছবি: সুহাদা আফরিন

আজ পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য অপেক্ষায় থাকা বাস থেকে যাত্রীরা নেমে এসেও ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন। মো. সুমন নামে এক যাত্রী উত্তরা যাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, ‘সিটিং সার্ভিসের কথা বলে ভাড়া আদায় করলেও পথ থেকে যাত্রী তোলে। যদিও ভাড়া কমায় না।’ অপর যাত্রী বাসের ভেতরে বসলে আর নড়াচড়া করতে পারেন না বলে অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, সিটে কেউ বমি করে গেছে, পরিষ্কার না করেই যাত্রী তোলা হয়। এ সময় গাড়িচালক হইচই শুরু করেন।

ওই যাত্রী বলেন, তাঁর কথা শোনার কেউ নেই। আজ ম্যাজিস্ট্রেটকে পেয়েছেন কথা বলবেনই। ম্যাজিস্ট্রেট নিজের আসন ছেড়ে গাড়ির ভেতরে গিয়েও দেখেন।

জাতীয় সংসদের উল্টো দিকে ভ্রাম্যমাণ আদালত সকাল থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত ১৩টি গাড়ি ধরে ৭ হাজার টাকা জরিমানা করেন। ফোরকান নামের এক গাড়িচালককে ২ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। তিনি খুশি মনে জরিমানা দিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ভাই ম্যাজিস্ট্রেট, মামাতো ভাই সাংবাদিক, মামা ইনকাম ট্যাক্স অফিসার। চাইলেই জরিমানা মাফ হইত। দিয়া দিলাম।’

রাজধানীর কাকলী বাসস্ট্যান্ডের পাশে বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত-৪ পরিচালনা করছিলেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এম এম সামিরুল ইসলাম। বেলা ১টা পর্যন্ত ৭টি মামলা ও ৯ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন।

দুপুরের দিকে একটি বাস থামানো হলে আদালত বাসের ভেতরে গিয়ে দেখেন সংরক্ষিত আসনে কারা বসেছেন। এ ছাড়া বাসটির ফিটনেসও দেখা হয়। বিকাশ পরিবহনের একটি বাস থামানো হলে আদালত দেখেন গাড়ি এবং চালকের কোনো কাগজপত্রেরই মেয়াদ নেই। বাসটি জব্দ করা হলে যাত্রীরা সবাই নেমে যান। বাসের চালক শিবলু রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর লাইসেন্স নবায়নের জন্য কাগজপত্র জমা দেওযা হয়েছে।  নতুন আইন জানতেন কিনা এবং গাড়ি নিয়ে চলাচলের বিষয়ে বলেন, ‘জানি আইন হইছে, কিন্তু মালিকে তো গাড়ি নায় নামতে মানা করল না।’ 

মো. আলমগীর নামের এক মোটরসাইকেল চালককে ৫০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তিনি জানান, তাঁর চার চাকার বাহন চালানোর লাইসেন্স আছে। কিন্তু মোটরসাইকেলের না থাকায় জরিমানা করা হয়েছে।

এবার জরিমানার পরিমাণ বেশি হওয়ায় এ নিয়ে মানুষের মনে নানা আলোচনা চলছে। ম্যাজিস্ট্রেট এম এম সামিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘জরিমানার সর্বোচ্চ পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। তবে সর্বনিম্নটা বলা হয়নি। জরিমানার পরিমাণ নির্ভর করছে অপরাধের পরিমাণ ও আদালতের ওপর। অনেকের মধ্যে ভীতি সঞ্চারও হয়েছে এটা নিয়ে যে ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকলেই ২৫ হাজার টাকা জরিমানা। কিন্তু এটা হচ্ছে সর্বোচ্চ পরিমাণ।’

নতুন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকরে মাঠে নেমেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ। ছবি: শেখ সাবিহা আলম
নতুন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকরে মাঠে নেমেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ। ছবি: শেখ সাবিহা আলম

কাকলীতে ট্রাফিক সার্জেন্ট আফসানা ফেরদৌস পথচারীদের সামলানো নিয়ে কিছুটা বিরক্ত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সকাল থেকে কয়েকবার গাড়ি থামিয়ে পথচারীদের পার করে দেওয়া হয়েছে। একজন-দুজন করে আসতেই থাকে। সবার জন্য যদি গাড়ি থামাতে হয়, তাহলে তো সড়কে গাড়িই চলবে না। আর ফাঁক পেলেই সড়কের মাঝ দিয়ে দৌড় দেবে। পথচারী মেনটেইন অনেক টাফ।’ তবে আজ পথচারীদের কোনো শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না বলে জানান কাকলীতে আদালত পরিচালনা করা ম্যাজিস্ট্রেট।

ভ্রাম্যমাণ আদালত থেকে কয়েক গজ দূরে বাসস্ট্যান্ডে চালকের সহকারীরা চালকদের সড়কের ডান দিক দিয়ে চলে যেতে বলছেন, যাতে আদালতের সামনে না পড়েন। এ ছাড়া আদালতের সামনে এসে দেখছিলেন মো. মনিরুজ্জামান। নিজেকে বঙ্গবন্ধু পরিবহনের মালিক পরিচয় দিয়ে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমাদের কথা কেউ বলে না। সব জগাখিচুড়ি অবস্থা। যা যায় সব মালিকের ওপর দিয়া।’ তাঁর অভিযোগ, মামলার পর মামলা হয়, কিন্তু দ্রুত তার ফয়সালা হয় না। চালকদের লাইসেন্স প্রক্রিয়াতে বিআরটিএর ওপর ক্ষোভ ঝেড়ে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘একটা লাইসেন্স করতে সাত-আট হাজার টাকা লাগে। ড্রাইভার গরিব, এত টাকা কই পাইব। আর একবার নবায়ন করতে দিলে দিনের পর দিন পার হয়, কাগজ বাইর হয় না, আর রাস্তায় নামলেই মামলা খায়।’ তবে তিনি জানান, আইনের প্রতি তাঁরাও শ্রদ্ধাশীল। চালকদের নিয়মিত সচেতন করেন।