লবণকাণ্ডে তুলকালাম

বস্তায় বস্তায় লবণ কিনে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। গতকাল বিকেলে সৈয়দপুর শহরের জহুরুল হক সড়কে।  প্রথম আলো
বস্তায় বস্তায় লবণ কিনে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। গতকাল বিকেলে সৈয়দপুর শহরের জহুরুল হক সড়কে। প্রথম আলো

কি পুরুষ, কি নারী, কি শিশু, কি বৃদ্ধ—পড়িমরি করে ছুটছেন দোকানে। যে যাঁর সামর্থ্য অনুযায়ী লবণ কিনছেন। হাতে, ব্যাগে, বস্তায় করে সেসব লবণ নিয়ে ফিরছেন সবাই। কাল থেকে দাম বেড়ে যাবে—এমন গুজবে এ ‘লবণকাণ্ড’।

কার কাছ থেকে দাম বাড়ার খবর পেলেন, তার সদুত্তর নেই কারও কাছে। কেউ শুনেছেন পাশের বাড়ির ভাবির কাছে। কেউবা বন্ধুর কাছে। পথচারীদের কাছেও শুনেছেন কেউ কেউ।

দেশের বিভিন্ন স্থানের মতো গতকাল মঙ্গলবার দিনভর এ অবস্থা ছিল রংপুর বিভাগেরও সব জেলায়। পরে গুজব ঠেকাতে বিভিন্ন স্থানে মাইকিং করে প্রশাসন। দাম বেশি নেওয়ায় করা হয় জেল-জরিমানাও।

বেলা ১১টার দিকে দিনাজপুর শহরে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। বাহাদুর বাজার, গুদরীবাজার, সুইহারিবাজার, ফুলবাড়ী বাসস্ট্যান্ড, বড় বন্দর রেলবাজারসহ অলিগলির দোকানে লবণক্রেতা মানুষের ভিড় বেড়ে যায়। খুচরা ব্যবসায়ীরাও বড় দোকান ও আড়তদারদের কাছ থেকে কেনেন লবণ। অনেক দোকানে লবণ বিক্রি হয়েছে কেজি ৫০-১০০ টাকা।

বাহাদুর বাজারে লবণ কিনতে আসেন মুফাচ্ছিরুল আহমেদ। তিনি বলেন, ‘দোকানদারের কাছে ১০ কেজি চেয়েছিলাম। ৩ কেজি দিলেন। কেজি ৪৫ টাকা।’

গুজব ঠেকাতে বেলা ৩টার দিকে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ফিরুজুল ইসলাম ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শামসুজ্জাহান কনকের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালান। এ সময় বেশি দামে বিক্রি করার দায়ে বাহাদুর বাজার এলাকায় রফিক ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মনির হোসেনকে ১০ হাজার, আমিন স্টোরের স্বত্বাধিকারী সজীব আহমেদকে ৫০ হাজার এবং নিউ আজাদ ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মোস্তা হাসানকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেন আদালত। বিকেলে জেলা প্রশাসক মো. মাহমুদুল আলম শিল্প ও বণিক সমিতির প্রতিনিধিদের সঙ্গে জরুরি সভা করেন।

পঞ্চগড়ে দুপুর ১২টার দিকে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় বিভিন্ন এলাকা থেকে ক্রেতারা লবণ কিনতে ভিড় শুরু করেন। প্রতি কেজি খোলা লবণ বিক্রি হয় ৩০ থেকে ৩৫ টাকা দরে। আর প্যাকেটজাত লবণ বিক্রি হয়েছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা দরে।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আবদুল মান্নান বলেন, গুজবে কান না দিতে মাইকিং করা হচ্ছে। বর্তমানে স্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

লালমনিরহাট সদর উপজেলায় বেশি দামে লবণ বিক্রির দায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত তিন দোকানদার ও এক কর্মচারীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন। ইউএনও জয়শ্রী রানী রায় সন্ধ্যা ৭টায় তাঁর কার্যালয়ে এ দণ্ডাদেশ দেন। 

ইউএনও জয়শ্রী রানী রায় বলেন, ৩০ থেকে ৬০ টাকা দরে লবণ বিক্রির দায়ে এ সাজা দেওয়া হয়।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও লালমনির হাট–৩ আসনের সাংসদ জি এম কাদের বলেন, এভাবে গুজব ছড়িয়ে মুনাফা করা অসৎ মানুষের কাজ। এভাবে সাধারণ মানুষকে ঠকানো উচিৎ নয়। 

পাটগ্রাম উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজারে দুপুরে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। বিকেল ৫টার দিকে ভারপ্রাপ্ত ইউএনও দীপক কুমার দেবশর্মা ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুমন কুমার মহন্ত পৌর বাজারে গিয়ে বাজার তদারক করেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হয়।

নীলফামারী সদর, ডোমার, ডিমলা, জলঢাকা ও কিশোরগঞ্জ শহরে সকাল থেকে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। প্রতি কেজি লবণের দাম দেড় শ টাকায় উঠেছে বলে প্রচারণা চালানো হয়। বিকেলে লবণ কিনতে জেলা শহরের বড় বাজারে আসেন রামনগর গ্রামের এরশাদুল আলম। তিনি বলেন, ‘গ্রামের বাজারে দাম বাড়ার কথা শুনে শহরে এসেছি। ৫ কেজি কিনলাম।’

জেলা প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের টিম মাঠে নেমেছে। জনগণকে গুজবে কান না দিতে মাইকিং করা হচ্ছে।’

সন্ধ্যায় সৈয়দপুর শহরের লবণের পাইকারি আড়ত শহীদ জহুরুল হক সড়কে দেখা যায়, সারি সারি পিকআপ-ভ্যান ও ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। এসবে তোলা হচ্ছে লবণের বস্তা। ব্যবসায়ী আশরাফ আলী জানান, দিনাজপুরের চিরিরবন্দর, খানসামা, পার্বতীপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, রংপুরের তারাগঞ্জ, বদরগঞ্জ, নীলফামারীর ডোমার, ডিমলা, জলঢাকা ও কিশোরগঞ্জের ব্যবসায়ীরা লবণ নিয়ে যাচ্ছেন।

লবণের কেজি দেড় শ থেকে দুই শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে—এমন গুজবে ঠাকুরগাঁওয়ে ক্রেতারা হুমড়ি খেয়ে পড়েন বাজারে। কালীবাড়ি ও ঠাকুরগাঁও রোড এলাকায় দেখা যায়, লবণ কিনতে ক্রেতাদের ভিড়।

বেশি দামে লবণ বিক্রি করার দায়ে শহরের তিন ব্যবসায়ীকে ১৫ দিন করে বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। তাঁরা হলেন কালিবাড়ী বাজারের মাসুদ রানা, মুন্সিপাড়া এলাকার সিরাজুল ইসলাম ও সত্যপীর ব্রিজ এলাকার নবাব আলী।

জেলা প্রশাসক কে এম কামরুজ্জামান বলেন, জেলা প্রশাসন গুজব মোকাবিলায় সক্রিয় আছে।

গাইবান্ধা শহরে সকাল ১০টা থেকে লবণ কেনার হিড়িক পড়ে যায়। সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সাঘাটা, পলাশবাড়ী ও সাদুল্যাপুর উপজেলা সদর এবং গ্রামগঞ্জের হাটবাজারেও সকাল থেকে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এ সুযোগে লবণ কেজিতে  ২০ থেকে ৪০ টাকা বাড়িয়ে বিক্রি করেন অনেকে।

গুজব ঠেকাতে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বিভিন্ন লবণের দোকান পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি দোকানদারদের অতিরিক্ত লবণ বিক্রি না করার পরামর্শ দেন। জেলা প্রশাসক মো. আবদুল মতিন বলেন, বাজার তদারক করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

রংপুর নগরের পাড়া-মহল্লার দোকানগুলোয় লবণ কেনার হিড়িক পড়ে। তবে দাম বেশি নেওয়া হয়নি। পরে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে নগরে মাইকিং করা হয়। এতে বলা হয়, লবণের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে দেশে।

সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান বলেন, গুজবে কান না দেওয়ার জন্য মাইকিং করে সবাইকে সচেতন করা হচ্ছে।

[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, রংপুর এবং প্রতিনিধি, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, পাটগ্রাম, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, সৈয়দপুর ও পঞ্চগড়]