মামলা ও তদন্তের চাপে মিয়ানমার

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর চরম নৃশংসতার মুখে লাখো রোহিঙ্গা প্রাণে বাঁচতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। রয়টার্স ফাইল ছবি
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর চরম নৃশংসতার মুখে লাখো রোহিঙ্গা প্রাণে বাঁচতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। রয়টার্স ফাইল ছবি
>আন্তর্জাতিক আদালতে মামলার শুনানি ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বর। তদন্ত শুরু করছে আইসিসি।

রোহিঙ্গা গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা ও তদন্তের ঘটনা দেশটিকে এই প্রথম বৈশ্বিক পরিসরে চাপে ফেলেছে। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার মামলা আর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) অভিযোগ তদন্তের সিদ্ধান্তে গণহত্যার দায় যে মিয়ানমারের এড়ানোর সুযোগ নেই, সেটা স্পষ্ট। 

গত সপ্তাহে আর্জেন্টিনার আদালতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর হুমকি সৃষ্টির অভিযোগে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি, সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইংসহ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো। রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতার অভিযোগে এই প্রথমবারের মতো সু চিকে কাঠগড়ায় আনার পদক্ষেপ মিয়ানমারের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভাবমূর্তিকে আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রশ্নবিদ্ধ করল।

নেদারল্যান্ডসের একটি কূটনৈতিক সূত্র গতকাল প্রথম আলোকে জানিয়েছে, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলা করার এক মাসের মধ্যে আইসিজে এ বিষয়ে শুনানি ডেকেছে। আগামী ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বর এ নিয়ে গাম্বিয়া ও মিয়ানমার দুই দফা শুনানি ও পাল্টা-শুনানিতে অংশ নেবে। এর মধ্য দিয়ে মোটামুটি দ্রুততম সময়ের মধ্যেই বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হলো।

ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা গতকাল প্রথম আলোকে জানান, আইসিসির বিচার-পূর্ব ট্রাইব্যুনালে তদন্তের অনুমতির পর আদালতের কর্মকর্তারা আগামী মাসে বাংলাদেশে কাজ শুরু করতে যাচ্ছেন। কাজের প্রক্রিয়াগত বিষয়গুলো সুরাহার জন্য গত সপ্তাহে আইসিসি বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছে। কক্সবাজার ও ঢাকায় দপ্তর চালু করে স্বাধীনভাবে তদন্তের কাজটি করবে আইসিসি।

কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে, রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) পক্ষে আইসিজেতে গাম্বিয়ার মামলা, আইসিসিতে তদন্তের অনুমতি আর আর্জেন্টিনার আদালতে সু চির বিরুদ্ধে মামলা আন্তর্জাতিক পরিসরে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া শুরু হলো। এতে দেশটি নতুন করে চাপে পড়ায় রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের সামনে নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশকে এ সমস্যা সমাধানের জন্য চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক গতকাল তাঁর দপ্তরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘রোহিঙ্গা সমস্যার টেকসই সমাধানের জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত করাটা অপরিহার্য। বিষয়টি শুরু থেকেই বাংলাদেশ বলে আসছে। এখন আইসিজে আর আইসিসির পদক্ষেপের মাধ্যমে এটা স্পষ্ট হলো যে রাখাইনে নৃশংসতার মাধ্যমে চরম মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে। এতে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক পরিসরে আইনি চাপ তৈরি হলো। তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, ’৭৮ ও ’৯২ সালে রোহিঙ্গা বিতাড়নের জবাবদিহি করা হয়নি। তাই রোহিঙ্গারা রাখাইনে ফিরে গিয়েও বারবার বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য হয়েছে।’

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের ওপর মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্তের জন্য জাতিসংঘের গঠিত মিয়ানমারবিষয়ক স্বাধীন তদন্ত কমিটির একটি প্রতিনিধিদল গত সপ্তাহে কক্সবাজার সফর করেছে। এ সময় প্রতিনিধিদলটি ঢাকায় পররাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে বৈঠক করে। গত বছরের অক্টোবরে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে বিশেষ প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে গঠিত ওই কমিটি এ বছরের আগস্ট থেকে কাজ করছে।

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবীর গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, রাখাইনে গণহত্যার দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা জরুরি। বিচারের রায় মিয়ানমারের বিপক্ষে যাবে। কারণ, অপরাধগুলো ঘটেছে মিয়ানমারে। এখন পর্যন্ত মিয়ানমার রোহিঙ্গা সমস্যাকে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে সামাল দিয়ে যাচ্ছে। আইনি প্রক্রিয়ায় দেশটির বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হলে তাকে দায় নিতে হবে। বাংলাদেশের জন্য এটা একটা নতুন সুযোগ।

হুমায়ুন কবীরের মতে, আইনি প্রক্রিয়ায় যে সিদ্ধান্ত আসবে, তা কারও আটকে দেওয়ার সুযোগ নেই। ফলে চীন, রাশিয়া, ভারত ও জাপান এখন পর্যন্ত মিয়ানমারকে সমর্থন দিয়ে গেলেও একসময় আইনি পদক্ষেপকে পাশ কাটানোর সুযোগ থাকবে না।

ঢাকা ও ইয়াঙ্গুনের কূটনৈতিক সূত্রগুলো মনে করছে, মিয়ানমার নিয়ে জাপান ও ভারতের অবস্থানের পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চির সঙ্গে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের বৈঠকের কথা তারা উল্লেখ করেছে। গত ২১ অক্টোবর মিয়ানমারের প্রশাসনিক রাজধানী নেপিডোতে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে শিনজো আবে বলেছেন, রাখাইনের বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীকে ফিরিয়ে নিতে রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ তৈরি অপরিহার্য। এ ছাড়া এ মাসের প্রথম সপ্তাহে ব্যাংককে আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ থেকে দ্রুত, নিরাপদ ও টেকসই উপায়ে রাখাইনের বাস্তুচ্যুত লোকদের ফেরানোর ওপর জোর দিয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের (সিজিএস) পরিচালক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ গতকাল দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, আইসিজে, আইসিসি ও আর্জেন্টিনার আদালতে মামলা আর তদন্তের পদক্ষেপের পর এটা স্পষ্ট যে আন্তর্জাতিক পরিসরে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, যা গত দুই বছরে ছিল না। এ পদক্ষেপগুলো মিয়ানমারের ওপর বৃহৎ পরিসরে চাপ তৈরির ক্ষেত্র তৈরি করে দিল বাংলাদেশকে। এখন বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডাসহ পশ্চিমা দেশগুলোকে বলতে পারে, গাম্বিয়া এগিয়ে এলে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে তোমাদের বাধা কোথায়। তেমনি এসব আইনি পদক্ষেপে এত দিন যারা জাতিসংঘের বিভিন্ন ফোরামে ভোট দেয়নি (যেমন ভারত, জাপান) কিংবা মিয়ানমারের পক্ষে ভোট দিয়েছে (যেমন চীন, রাশিয়া), তাদের প্রতি নতুন করে আহ্বান জানাতে বাংলাদেশের জন্য সুযোগ তৈরি হলো।

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এই শিক্ষক এটাও মনে করেন, আত্মতুষ্টিতে না ভুগে রোহিঙ্গা সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশকে সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট নিরাপত্তাচৌকিতে সন্ত্রাসীদের হামলাকে অজুহাত দেখিয়ে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর চরম নৃশংসতা শুরু করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। নির্বিচার হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন থেকে বাঁচতে পরের কয়েক মাসে অন্তত সাত লাখ রোহিঙ্গা প্রাণে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। জাতিসংঘ এই নৃশংসতাকে গণহত্যা হিসেবে অভিহিত করেছে।