পানিতে ১২ হাজার মানুষের খেত আর মাছের ক্ষতি

সাতক্ষীরা বদ্দিপুর কলোনি এলাকা। ছবি: প্রথম আলো
সাতক্ষীরা বদ্দিপুর কলোনি এলাকা। ছবি: প্রথম আলো

সাতক্ষীরা পৌর এলাকার একাংশ ও ব্রক্ষরাজপুর ইউনিয়নের বেশির ভাগ এলাকা চার মাস ধরে জলাবদ্ধ। এই জলাবদ্ধতায় এসব এলাকার আড়াই হাজার পরিবারের প্রায় ১২ হাজার মানুষ পানিবন্দী। এসব পরিবারের বাড়ির আঙিনায় পানি থই থই করেছে। ভেঙে পড়ছে স্যানিটেশন ব্যবস্থা।

পানিতে ডুবে আছে ফসলের খেত, মাছের ঘেরসহ রাস্তাঘাট। পলি জমে বেতনা নদীর তলদেশ উচ্চ হওয়ার পাশাপাশি মাছ চাষের নামে খাল দখল হওয়ায় পানি বের হতে পারছে না। ফলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। সেচ দিয়ে পানি কিছুটা কমলেও ঘূর্ণিঝড় বুলবুল’র পর ফের পানি বৃদ্ধি পেয়েছে।

আজ শুক্রবার সকালে গিয়ে দেখা যায়, বিজিবি সদর দপ্তরের পেছনের অংশ পৌর এলাকার ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডের গদাইবিল, ঢালীপাড়া, কুলিনপাড়া, পূর্ব রাজারবাগান, পুরোনো সাতক্ষীরা সরদারবাড়ি, বদ্দিপুর কলোনি, মাদ্রাসাপাড়া, দাসপাড়া ও ঋষিপাড়া এবং ব্রক্ষরাজপুর ইউনিয়নের শ্যালে, মাছখোলা, সুদুরডেঙ্গি, জিয়ালা, রামচন্দ্রপুর, বাধনডাঙ্গাসহ বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে তলিয়ে আছে। এসব এলাকার বাড়ি আঙিনায় দুই থেকে আড়াই ফুট পানি। বাড়ি থেকে কাজের সন্ধানে পুরুষ মানুষ পানি ঠেলে বের হলেও নারীরা বের হতে পারছেন না। রাস্তাঘাট সব পানির নিচে।

সরদারবাড়ি এলাকার প্রকৌশলী লুৎফর রহমান জানান, বিজিবি ক্যাম্প থেকে বদ্দিপুর কলোনি, আবার বদ্দিপুর কলোনি থেকে আলীয়া মাদ্রাসাসহ প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকা পানিতে তলিয়ে রয়েছে। মানুষ খুব প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যাচ্ছেন না। অধিকাংশ পরিবারকে খাবার পানি কিনে খেতে হচ্ছে। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বিড়ম্বনার শেষ নেই। পানি নিষ্কাশনের সব পথ বন্ধ থাকায় রোদে পানি শুকিয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। আড়াই-তিন হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে এভাবে চার মাস ধরে জীবনযাপন করছেন। এমন অবস্থা চলতে থাকলে মানুষ এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য হবেন।

বদ্দিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাসুমা খাতুন জানান, বুলুবুলের প্রভাবে বৃষ্টিতে স্কুল আঙিনায় তিন ফুটের বেশি পানি জমে আছে। ফলে তাঁরা বিদ্যালয় বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছেন। তবে সমাপনী পরীক্ষার জন্য পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের সরদারপাড়ার একটি বাড়িতে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। সামনে অন্যান্য শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের চূড়ান্ত পরীক্ষা। কি করবেন বুঝতে পারছেন না।

কুলিনপাড়ার ব্যবসায়ী মানিক সরদার ও আনিসুর রহমান জানান, গত জুলাই মাসের শেষের দিকে বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যায় বিস্তীর্ণ এলাকা। এ সময় তাঁদের বাড়িসহ আশপাশের এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। সেচ দেওয়ায় একটু পানি কমেছিল। কিন্তু বুলবুল’র সময় প্রবল বৃষ্টিতে পানি আবার বেড়ে যাওয়ায় মানুষের ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে।

কুলিনপাড়া কৃষক রবিউল ইসলাম, মাছ চাষি একরামুল আহমেদ ও রমজান আলী জানান, তাঁদের বাড়ির আঙিনায় হাঁটু পানি মাসে পর মাস ধরে জমে আছে। সড়কেও পানি। এসব পানি ঠেলে তাঁরা চলতে পারলেও তাঁদের ছেলে-মেয়েরা স্কুল-কলেজে যেতে পারছেন না। বেতনা নদীর পাশাপাশি সংযোগ খাল না কাটা পর্যন্ত এ অবস্থার নিরসন হওয়া কঠিন। এরপরও পৌর কর্তৃপক্ষ, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বা ইউনি পরিষদের পক্ষ থেকে তেমন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।

পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শেখ আব্দুস সেলিম জানান, ১, ২,৩ নম্বর ওয়ার্ড মিলে এক হাজার ও ব্রক্ষরাজ ইউনিয়নের আরও হাজার দুয়েক পরিবার পানিবন্দী। পানিবন্দী এসব পরিবারের সদস্যরা দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। খাবার পানিরও চরম সংকট রয়েছে।

সেলিম জানান, গদাইবিল, কেলোরবিল, শিবতলাবিল, সুন্দরডাঙ্গিসহ ৮-১০ বিল ও গ্রামের পানি তিন নম্বর ওয়ার্ডের ওপর দিয়ে নিষ্কাশন হয়। তিনি বুলবুল’র আগে পানি সেচ দিয়ে কিছুটা কমিয়ে ছিলেন। কিন্তু বুলবুলের প্রভাবে বৃষ্টির কারণে পানি বেড়েছে। বর্তমানে মাছখোলা ও সাকলারগেট এলাকায় ১৬টি সেচযন্ত্র দিয়ে সেচ দেওয়া হচ্ছে। তাতে পানি তেমন কমছে না। দ্রুত পানি কমানোর জন্য আজ সকালে ঘুরেরডাঙ্গি বিলসহ আশপাশের মাছের ঘেরের ১০ স্থানের বেড়ি কেটে দেওয়া হয়েছে।

সাতক্ষীরা পাউবোর (বিভাগ-২) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফউজ্জামান বলেন, বর্তমানে কোনো বরাদ্দ নেই। ফলে কাজ করা যাচ্ছে না। বেতনা নদীতে পলি জমে নদীর বুক পর্যন্ত উচু হয়েছে। ফলে পানি নিষ্কাশনের সুযোগ কম। সেচ দিয়ে পানি সরানো ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। পাউবোর ১,২ ও ৬ নম্বর পোন্ডারের বেতনা ও মরিচ্চাপ নদীর সঙ্গে সংযুক্ত ৮৮ খাল কাটতে ৪৭১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এ প্রকল্প অনুমোদন হলে এসব নদী ও খাল খনন করার পর জলাবদ্ধতা থাকবে না।