ট্রমা সেন্টারটি নিজেই মুমূর্ষু

ফেনী ট্রমা সেন্টারে চালু আছে শুধু বহির্বিভাগের সেবা। সম্প্রতি ফেনীর মহিপালে।  প্রথম আলো
ফেনী ট্রমা সেন্টারে চালু আছে শুধু বহির্বিভাগের সেবা। সম্প্রতি ফেনীর মহিপালে। প্রথম আলো

চালু হওয়ার পর দীর্ঘ প্রায় ১৩ বছরেও কোনো হাড় ভাঙা ও দুর্ঘটনায় আহত (ট্রমায় আক্রান্ত) রোগীর চিকিৎসা হয়নি ফেনী ট্রমা সেন্টারে। বকেয়া বিল পরিশোধ না করায় পাঁচ বছর আগে বিদ্যুৎ–সংযোগ কেটে দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। নেই পানির সরবরাহও। গত আট মাস যাবৎ বেতন-ভাতা পান না চিকিৎসক-কর্মচারীরা। প্রতিদিন বহির্বিভাগে হাতে গোনা কিছু রোগী আসে চিকিৎসা নিতে। এ ছাড়া ট্রমা সেন্টারটির আর কোনো কার্যক্রম নেই। সব মিলিয়ে হাসপাতালটি এখন নিজেই মুমূর্ষু।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফেনী ট্রমা সেন্টারে ২২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদ থাকলেও বর্তমানে দুই চিকিৎসা কর্মকর্তা, নার্স, ফার্মাসিস্টসহ মোট নয়জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে তিনজন নার্স রাঙামাটিতে প্রশিক্ষণে রয়েছেন। বর্তমানে দৈনিক গড়ে ১৪-১৫ জন সাধারণ রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসে।

গত মঙ্গলবার বেলা ১১টায় ফেনী–নোয়াখালী সড়কের মহিপালে অবস্থিত ট্রমা সেন্টারে গিয়ে দেখা যায়, তিনতলা ভবনটির অধিকাংশ কক্ষই বন্ধ। বহির্বিভাগে তিন-চারজন রোগী চিকিৎসার জন্য এসেছে। তাদের সবাই জ্বর, সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত। হাড় ভাঙা ও দুর্ঘটনায় আক্রান্ত কোনো রোগী নেই। জরুরি বিভাগে একজন চিকিৎসা কর্মকর্তা রোগীদের সেবা দিচ্ছিলেন। তিনি ছাড়াও পাশের দুটি কক্ষে পাওয়া গেল একজন ফার্মাসিস্ট ও একজন উপসহকারী চিকিৎসা কর্মকর্তাকে। একতলার তিনটি কক্ষে চিকিৎসক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা থাকলেও কোথাও পাখা ও বাতি জ্বলছিল না। বিদ্যুৎ–সংযোগ না থাকায় পাখার গায়ে জমেছে মাকড়সার ঝুল ও ধুলার আস্তর। নিচতলার তিনটি কক্ষ ছাড়া দুতলা ও তিনতলার আর কোনো কক্ষই খোলা ছিল না। দুটি অপারেশন থিয়েটার, রেডিওলজি বিভাগ, ল্যাব, রোগীদের ওয়ার্ড ও কেবিনে ঝুলছিল তালা। চালুর পর থেকে সেসব কক্ষ ব্যবহৃত হয়নি। কক্ষগুলোতে শল্যচিকিৎসার মূল্যবান যন্ত্রপাতি, এক্স-রে ও চিকিৎসা সরঞ্জাম পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। শৌচাগারসহ হাসপাতালের কোথাও নেই পানির ব্যবস্থা। চিকিৎসক ও কর্মচারীদের খাওয়ার পানি বাইরে থেকে সংগ্রহ করতে হয়।

>

ফেনীর মহিপাল সেন্টারটিতে হাড় ভাঙা ও দুর্ঘটনার রোগী যায় না
পাঁচ বছর ধরে বিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ–সংযোগ
চিকিৎসক ও কর্মচারীদেরও বেতনও বন্ধ

কথা হয় কর্তব্যরত চিকিৎসা কর্মকর্তা (এমও) সানজিদা খানমের সঙ্গে। তিনি বলেন, রোগী নেই তাই অলসভাবে সময় কাটে। বেতনও বন্ধ আট মাস ধরে।

সেন্টারে কর্মরত আরেকজন চিকিৎসা কর্মকর্তারও একই দশা। তবে সেদিন তিনি সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে একটি বৈঠকে যোগ দিতে যান বলে জানা গেছে।

উপসহকারী কমিউনিটি চিকিৎসা কর্মকর্তা জান্নাতুল ফেরদাউস বলেন, তিনি ট্রমা সেন্টারে প্রেষণে এসেছেন। তাঁর প্রেষণও উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে সম্প্রতি প্রত্যাহার করা হয়েছে। যেকোনো সময় তিনি সেখানে ফিরে যাবেন। তিনি জানান, সেন্টারে প্রতিদিন গড়ে ১৪-১৫ জন সাধারণ রোগী আসেন। তাদের রোগের কথা শুনে ব্যবস্থাপত্র দেওয়া হয়।

ট্রমা সেন্টার–সংলগ্ন মহিপাল এলাকার বাসিন্দা আবুল খায়ের ও নুরুল আফছার নামে দুই ব্যক্তি অভিযোগ করে বলেন, প্রতিদিন মহিপালের ওপর দিয়ে হাজার হাজার যাত্রীবাহী বাস, ট্রাক, টেম্পো, অটোরিকশা চলাচল করে। প্রায়ই দুর্ঘটনায় লোকজন আহত হয়। কিন্তু ট্রমা সেন্টারে গিয়ে কোনো চিকিৎসক পাওয়া যায় না। কখনো পাওয়া গেলেও তাঁরা চিকিৎসা না দিয়েই ফেনী সদর হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। এ কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রোগীদের এখন ট্রমা সেন্টারে নেওয়া হয় না।

চিকিৎসা কর্মকর্তা (এমও) সানজিদা খানম জানান, কোনো হাড় ভাঙা বা সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রোগী ট্রমা সেন্টারে গেলে তাকে ফেনীর ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও জনবল না থাকায় রোগীদের ফেরত পাঠাতে বাধ্য হন তাঁরা। যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসা সরঞ্জাম থাকলেও সেসব ব্যবহারের জন্য প্রশিক্ষিত জনবল নেই। নেই বিদ্যুৎ আর পানিও।

তিনি জানান, ট্রমা সেন্টারটি বর্তমানে শুধু বহির্বিভাগ হিসেবে চালু রয়েছে। বহির্বিভাগের সাধারণ রোগীদের জন্য সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে কিছু ওষুধ দেওয়া হয়। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসনের কোনো ব্যবস্থা নেই। সেন্টারে কোনো নৈশপ্রহরী না থাকায় রাতের বেলায় এটি সম্পূর্ণ অরক্ষিত পড়ে থাকে।

জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানায়, ফেনী ট্রমা সেন্টারটি ২০০৬ সালের ৩ অক্টোবর চালু করা হয়। ২০ শয্যার এ ট্রমা সেন্টারে একজন অর্থোপেডিক পরামর্শক চিকিৎসক, একজন অবেদনবিদ ও একজন আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তাসহ (আরএমও) ২২ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী থাকার কথা। কিন্তু বর্তমানে একজন চিকিৎসকসহ আটজন কর্মচারী রয়েছেন।

 জানতে চাইলে ফেনীর সিভিল সার্জন মো. নিয়াতুজ্জামান বলেন, ট্রমা সেন্টারটি পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করার বিষয়টি সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। ইতিপূর্বে এ বিষয়ে অনেকবার মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চিঠি লেখা হয়েছে। চিকিৎসা-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতনের জন্য টাকা বরাদ্দ দিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (অর্থ) বরাবরে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে।