বুড়িগঙ্গার তীরে বাজার বসাল বিআইডব্লিউটিএ

বুড়িগঙ্গার তীরে তৈরি করা হচ্ছে দোকান। গতকাল দুপুরে সদরঘাট এলাকায়।  ছবি: প্রথম আলো
বুড়িগঙ্গার তীরে তৈরি করা হচ্ছে দোকান। গতকাল দুপুরে সদরঘাট এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে ওয়াইজঘাট থেকে সোয়ারীঘাট পর্যন্ত একসময় ছিল শত শত আড়ত ও দোকানপাট। মাস ছয়েক আগে নদীর পাড় থেকে এসব স্থাপনা অপসারণ করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। কিন্তু এখন ওই জায়গাতেই বাজার বসিয়েছে খোদ বিআইডব্লিউটিএ। ফলে উচ্ছেদের পর নদীর পাড়ে যে নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল, তা আবার হারিয়ে গেছে।

স্থানীয় ব্যবসায়ী ইকরামুল ইসলাম বলছেন, সদরঘাট এলাকা যানজটমুক্ত রাখতে ইতিমধ্যে ঢাকা নদীবন্দর কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়। এতে চিরচেনা সদরঘাটের চিত্র কিছুটা বদলেছিল। যাত্রীরাও এতে সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু সামান্য কিছু টাকা রাজস্ব আদায়ের জন্য বুড়িগঙ্গার তীরে বাজার বসানোর উদ্যোগে অনেকেই হতাশ হয়েছেন। তবে বিআইডব্লিউটিএ বলছে, তারা অনেক চিন্তাভাবনা করেই সেখানে বাজার বসানোর অনুমতি দিয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিআইডব্লিউটিএর এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় কয়েকজন নেতা-কর্মীকে আর্থিক সুবিধা দিতেই এই স্ববিরোধী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সদরঘাট এলাকায় বাজার বসানোর জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দুজন কাউন্সিলর এবং ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের চাপের মুখেই সংস্থাটি সেখানে বাজার বসানোর অনুমতি দিয়েছে। একটি বাজার বসানোর অনুমতি দেওয়ার কারণে পর্যায়ক্রমে অন্য এলাকায়ও বাজার বসানোর চাপ আসতে পারে। সে ক্ষেত্রে অন্যদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে।

>

বিআইডব্লিউটিএর এমন সিদ্ধান্তে হতবাক অনেকে। বুড়িগঙ্গার তীরে এভাবে বাজার বসানোর অনুমতি দেওয়া ঠিক হয়নি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ঢাকা নদীবন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ১৫ নভেম্বর থেকে ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ওয়াইজঘাট ও সোয়ারীঘাট এলাকার মাঝখানের জায়গায় বাজার বসানোর জন্য অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এই তিন মাসের জন্য প্রায় সোয়া দুই লাখ টাকায় আনোয়ার হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে সেখানে বাজার বসানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তিনি ঘাট শ্রমিক একতা সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি। কাগজে-কলমে আনোয়ার হোসেনকে বাজার বসানোর অনুমতি দেওয়া হলেও এর পেছনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবদুর রহমান মিয়াজি, ওয়ার্ড যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা, ঘাট শ্রমিক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাভেদ হোসেন ওরফে মিঠুসহ অন্তত ২৫ জন নেতা রয়েছেন। ইতিমধ্যে এখানে ৭৫টি দোকান বসানো হয়েছে জানিয়ে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় এক নেতা বলেন, প্রতিটি দোকান বসানোর জন্য ৫০ হাজার থেকে শুরু করে ৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে। এই হিসাবে প্রায় ৫৫ লাখ টাকা উঠেছে। এই টাকা বাজার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। বেঁধে দেওয়া সময়ে এই বাজার তুলে দেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ, সময় বাড়াতে পারলে মার্কেট ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্তদের লাভও বাড়বে। তাঁরা এই সুযোগ হাতছাড়া করবেন না। এ বিষয়ে জানতে
চাইলে কাউন্সিলর আবদুর রহমান মিয়াজি বলেন, তিনি এই মার্কেটের সঙ্গে জড়িত নন। তবেশুনেছেন বিআইডব্লিউটিএ সেখানে বাজারের অনুমোদন দিয়েছে।

গতকাল শুক্রবার সরেজমিনে দেখা গেছে, বাজার বসানোর জন্য নির্ধারণ করে দেওয়া জায়গায় ইতিমধ্যে অবকাঠামো নির্মাণের কাজ চলছে। বাঁশের খুঁটি পুঁতে শামিয়ানা টানানোর কাজ করছেন ব্যবসায়ীরা। কয়েকটি দোকানে ইতিমধ্যে বেচাবিক্রিও শুরু হয়েছে। বাজার বসাতে গিয়ে বুড়িগঙ্গার তীরে মাটিও ভরাট করা হয়েছে। দোকানিরা বলছেন, ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকায় তাঁরা সেখানে দোকান বসিয়েছেন। অবকাঠামো নির্মাণকাজ পুরোপুরি শেষ না হওয়ার কারণে ক্রেতাদের আনাগোনা তেমন ছিল না। তবে সেখানকার দোকানিরা বলছেন, শীতের প্রকোপ বাড়লে বেচাবিক্রির ধুম পড়বে।

বুড়িগঙ্গার তীরের যে অংশে বাজারটি বসানো হয়েছে, ওই পথ দিয়ে পটুয়াখালীগামী যাত্রীদের যাওয়া-আসার পথ। এই বাজার জমে উঠলে সেখানে লোকসমাগম বাড়বে। এতে করে যাত্রীদের ভোগান্তিতে পড়তে হবে বলে মনে করছেন অনেকে। যদিও বাজার বসানোর অনুমতিপত্রে পটুয়াখালীগামী যাত্রীদের স্বাভাবিক চলাচলে যাতে বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়, সেই শর্ত দেওয়া হয়েছে।

বাকল্যান্ড বাঁধ সিটি করপোরেশন মার্কেটের এক দোকানি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সদরঘাট এলাকার ফুটপাত দখলমুক্ত করার কারণে যাত্রীদের যাতায়াতে স্বস্তি ফিরেছে। আশপাশের এলাকায় বৃক্ষ রোপণ করার কারণে শোভা বেড়েছে। কিন্তু এই বাজার বসানোর কারণে গোটা এলাকায় আবার বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। দোকান বসালেই ৭০ হাজার টাকা পাওয়া যাবে—এ কারণে ইজারাদার একপর্যায়ে যত্রতত্র দোকান বসাতে পারেন। এতে করে বদলে যাওয়া সদরঘাট আবার আগের রূপেই ফিরবে।

জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক ও ঢাকা নদীবন্দরের নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা এ কে এম আরিফ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশে তিন মাসের জন্য সেখানে বাজার বসানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আগে এই বাজারটি যেখানে বসানো হতো, সেখানে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাই এই স্থানে বাজার বসানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান এয়ার কমোডর এম মাহবুব-উল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আগে সেখানে অবৈধ স্থাপনা ছিল, তা ভেঙে দিয়ে বৈধভাবে স্বল্প সময়ের বাজার বসানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। জনগণের সুবিধার জন্য চিন্তাভাবনা করে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই বাজার যাতে স্থায়ীভাবে সেখানে না থাকে, সেদিকে তাঁদের তীক্ষ্ণ নজর থাকবে বলেও জানান তিনি।