সরকারি সহায়তা চান সুমি

সুমি আক্তার
সুমি আক্তার

২০১৭ সালে স্থানীয় একটি বালিকা বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়তেন সুমি আক্তার। ফরম পূরণের টাকার অভাবে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষায় অংশ নেওয়া হয়নি তাঁর। ওই বছরই পড়ালেখার পাট চুকিয়ে পোশাকশ্রমিক খালা জুলেখা বেগমের সঙ্গে ঢাকায় চলে যান তিনি।

গাজীপুরে পোশাকশ্রমিক মামা হাসান আলীর ভাড়াবাড়িতে থেকে সুমি কাজ নেন একটি সোয়েটার কারখানায়। এক মাসের মাথায় ঢাকার আশুলিয়ার চারাবাগের নূরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তির নজরে পড়েন সুমি। মামি শরিফা বেগমের মাধ্যমে সুমিকে মুঠোফোন ও কাপড়চোপড় কিনে দেন নূরুল। একপর্যায়ে তিনি বিয়ে করতে চান সুমিকে। কিন্তু সুমি রাজি হননি। একদিন সুমি নিজের জুতা সেলাই করাতে মামার বাড়ির বাইরে গেলে একটি মাইক্রোবাসে করে নূরুল তাঁকে তুলে নিয়ে যান।

সুমিকে আশুলিয়ার একটি বাড়িতে আটকে রাখা হয়। সেখানে সাত দিন আটকে রেখে নির্যাতনের পর বিয়েতে রাজি হন সুমি। ওই সময় ১৫ বছর বয়সী সুমির জন্মনিবন্ধন সনদ দিয়ে নকল জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে তাঁকে প্রাপ্তবয়স্ক দেখিয়ে বিয়ে করেন নূরুল। পরে সুমি জানতে পারেন নূরুলের একাধিক স্ত্রী ও সন্তান রয়েছে। বিয়ের দুই দিন পরই আগের একটি মামলায় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন নূরুল। তিন মাস কারাগারে থাকেন তিনি। জামিনে বেরিয়ে তিনি সুমির সঙ্গে ভালোই ব্যবহার করেন। পরে তিনি তাঁর পরিচিত নারী দালালের মাধ্যমে সুমিকে সৌদি পাঠানোর সব কাগজপত্র প্রস্তুত করেন।

সুমির বয়স ২৫ বছর দেখিয়ে তাঁকে পাঠানো হয় সৌদি আরব। সেখানে সৌদির নিয়োগকর্তা দিনের পর দিন আটকের রেখে খাবার না দিয়ে শারীরিক, মানসিক, এমনকি পাশবিক নির্যাতন করেন তাঁকে।

গত শুক্রবার বিকেলে বাবার বাড়িতে বসে এভাবেই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের বর্ণনা দেন সৌদি থেকে ফিরে আসা সুমি। সুমি পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার পাঁচপীর ইউনিয়নের বৈরাতি সেনপাড়া এলাকার দিনমজুর রফিকুল ইসলামের মেয়ে। চার ভাইবোনের মধ্যে সুমি সবার বড়।
২০০২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি জন্ম হয়েছিল সুমির। সেই অনুযায়ী সুমির বয়স এখন ১৭ বছর ৯ মাস। তাঁর বয়সের বিষয়ে এমন তথ্য দেন সুমি ও তাঁর মা-বাবা। তবে ঢাকায় যাওয়ার পর সুমির বিয়ে ও বিদেশে যাওয়ার কিছুই জানতেন না বলে দাবি তাঁর মা-বাবার।

সুমি বলেন, ‘আমার বিয়েটা ছিল অপহরণের মাধ্যমে ও বয়স বেশি দেখিয়ে। স্বামী আমাকে টাকার লোভে বিদেশে পাচার করেন। আমি বিদেশে যেতে না চাইলে স্বামী আমাকে বলতেন, তাহলে তোমার বাবার কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা এনে দাও। এখন বিদেশ থেকে ফিরে নানা অসুস্থতায় ভুগছি। বিশেষ করে চোখের কর্নিয়ার সমস্যা প্রকট। সরকারের কাছে দাবি আমার সুচিকিৎসা ও ভবিষ্যতে চলার জন্য একটা কাজের। আমি স্বামীর কাছে যেতে চাই না বলে তিনি এখন নানাভাবে ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। মামলা দিয়ে ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন। আমি সরকারের কাছে নূরুলের হাত থেকে আমার পরিবারকে রক্ষার দাবি জানাই। নূরুল মাদক সেবন ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকায় তাঁর নামে একাধিক মামলা রয়েছে। এ ছাড়া আমাকে বিয়ে করে পাচার করাই ছিল নূরুলের মূল উদ্দেশ্য।’

সুমির বাবা রফিকুল বলেন, ‘সুমিকে বিদেশ থেকে আনতে হবে—এমন কথা বলে নূরুল আমার কাছে টাকা চেয়েছিল। আমি গরু বিক্রি করে তাকে প্রথমে ৩৬ হাজার টাকা দিই। পরে সুমি যেদিন বাড়িতে আসবে, সেদিনও টাকা চেয়েছিল নূরুল। সেদিনও আমি সুদের ওপর ১০ হাজার টাকা এনে তাকে দিই। অথচ এখন নূরুল আমাদের নামে মামলা করতে চাচ্ছে। সে আমার মেয়ের জীবন ধ্বংস করেছে, আবার উল্টো মামলার হুমকি দিচ্ছে।’

তবে নূরুল মুঠোফোনে বলেন, ‘সুমিকে আমি জোর করে বিয়ে করিনি। একসময় আমার মাদক নেওয়ার মতো খারাপ অভ্যাস ছিল, সুমিই আমাকে সেই পথ থেকে ভালো পথে ফিরিয়েছিল। বিয়ের কয়েক দিন পর আমি একটি মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে তিন মাস কারাগারে ছিলাম। জোর করে বিয়ে করলে তো সুমি তখনই চলে যেত।’ তবে তিনি সুমিকে বিদেশে পাঠাননি দাবি করে বলেন, ‘সুমি নিজের ইচ্ছায় বিদেশে যায়। সুমিকে দেশে ফিরিয়ে আনতে আমি বিভিন্ন জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করেছি। অনেক টাকাও খরচ করেছি। অথচ সুমি আমাকে দেখা না দিয়ে বাবার বাড়িতে চলে গেছে। সেখানে তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে আমি লাঞ্ছিত হয়েছি।’

বোদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ মাহমুদ হাসান বলেন, ‘সুমির বিষয়ে সার্বক্ষণিক খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। সুস্থ হলেই সুমিকে আমার কার্যালয়ে আসতে বলেছি। মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর বা অন্য কোনো মাধ্যমে সুমির কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায় কি না, সেটা ভেবে দেখা হচ্ছে। সুমি আমাকে জানিয়েছেন, তিনি স্বামীর সঙ্গে যেতে চান না। এরপরও সুমির ওপর যদি কেউ বলপ্রয়োগ করতে চান, তাহলে অবশ্যই তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

১৫ নভেম্বর দেশে ফেরেন সুমি। ওই দিন বিকেল পাঁচটার দিকে তাঁকে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) আবু হেনা মোস্তফা কামাল ইউএনও সৈয়দ মাহমুদ হাসানের কাছে হস্তান্তর করেন। পরে উপজেলার পাঁচপীর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবীর প্রধানের উপস্থিতিতে সুমিকে তাঁর মা-বাবার কাছে দেওয়া হয়।
এর আগে সৌদিতে নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে চেয়ে সুমির একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। পরে সরকার সৌদি দূতাবাসের মাধ্যমে সুমিকে উদ্ধারের প্রক্রিয়া শুরু করে।