আর্থিক সংকটে পড়ছে অক্সফোর্ড মিশন

বরিশালের ঐতিহ্যবাহী অক্সফোর্ড মিশন চার্চ। ছবি: সাইয়ান
বরিশালের ঐতিহ্যবাহী অক্সফোর্ড মিশন চার্চ। ছবি: সাইয়ান

প্রতিষ্ঠার প্রায় ১১৭ বছর পর বরিশালের ঐতিহ্যবাহী অক্সফোর্ড মিশনের আওতায় থাকা ১০টি প্রতিষ্ঠান আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়েছে। ব্রিটিশ সহায়তায় এত দিন এসব প্রতিষ্ঠান চলছিল। সম্প্রতি এক সভায় এই সহায়তা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। আগামী বছর থেকে আর সহায়তা দেওয়া হবে না। এতে মিশনের আওতাধীন এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সংশ্লিষ্টদের উদ্বেগ বাড়ছে।

নগরের বগুড়া রোডে অবস্থিত এপিফানি অক্সফোর্ড মিশন নামের এই ব্যাসিলিকা (দুই সারি স্তম্ভ ও এক গম্বুজের) দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম গির্জা।

গির্জাটি ১৯০৩ সালে নির্মিত। লাল ইটের তৈরি এই গির্জা সিস্টার এডিথের স্কেচের আদলে মূল আকৃতি দেন ফাদার স্ট্রং। এর নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯০৭ সালে। ফ্রেডরিক ডগলাস এটি নির্মাণ করেছিলেন। ১৮৯২ সালে তিনি প্রথম এই দেশে আসেন। ডগলাস ইংল্যান্ড অক্সফোর্ডের ক্রাইস্টচার্চে শিক্ষা লাভ করেন। একবার সন্ত্রাসী হামলায় মারাত্মকভাবে আহত এক পুলিশ সদস্যকে তিনি বাঁচিয়েছিলেন। তাঁর এই মহৎ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পুলিশ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ক্রুশবিদ্ধ যিশুর প্রতিকৃতি উপহার পেয়েছিলেন তিনি। সারা জীবন উপহারটি সঙ্গে রেখেছিলেন। ১৯০১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বরিশালে এবং ১৯০৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের বেহালায় ট্রাম টার্মিনালের দক্ষিণ পাশে তিনি ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁরই তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয় এই এপিফানি গির্জা।

১৯০৪ সালের ১৯ মার্চ ক্ষেত্রমণি দত্তের দেওয়া ২৫ হাজার টাকা ও বিদেশি বন্ধুদের আর্থিক সহায়তায় বরিশালের এপিফানি গির্জার নির্মাণকাজ শুরু হয়। উঁচু প্রাচীরঘেরা এই গির্জার অভ্যন্তরে ১৩টি ছোট-বড় পুকুর এবং অক্সফোর্ড মিশন প্রাইমারি স্কুল ও অক্সফোর্ড মিশন হাই স্কুল রয়েছে। এই গির্জায় রয়েছে অসংখ্য করিডর ও ৪০টি খিলানপথ, যা এর কাঠামোকে দিয়েছে বিশেষ দৃঢ়তা। যিশুর আশীর্বাদ–জ্ঞাপনস্বরূপ মূল বেদির ওপর একটি বিশাল আকৃতির ক্রুশ রয়েছে, যা দেশি–বিদেশি পর্যটক, বিশেষ করে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের আকর্ষণ করে। গ্রিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত অক্সফোর্ড মিশন গির্জার ভেতর আছে সুবিশাল প্রার্থনাকক্ষ।

প্রায় ৩৫ একর জমির একাংশে নির্মিত গির্জার ভেতরটা কাঠ দিয়ে খোদাই করা, আর মেঝেতে নজরকাড়া মার্বেল পাথরের টাইলসখচিত। গির্জাটি একতলা হলেও কমপক্ষে পাঁচতলা ভবনের সমান উঁচু।

দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম (একতলা উচ্চতায়) এই ব্যাসিলিকা এপিফানি গির্জাটি ঘিরে ১০টি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এর মধ্যে একটি মাধ্যমিক, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চারটি শিক্ষার্থী হোস্টেল, মেটারনিটি ক্লিনিক, ব্রাদারহুড, সিস্টারহুড, সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট, মিশনপাড়া (কোয়ার্টার), কবরস্থান, সেন্ট মেরিজ (প্রতিবন্ধী ও অনাথ আশ্রম)।

শুরু থেকেই ব্রিটিশ ফাদারদের গঠন করা একটি চ্যারিটির অনুদানে বরিশাল অক্সফোর্ড মিশন এবং ভারতের বেহালার মিশনটি পরিচালিত হতো। কিন্তু ২০২০ সালে এই অনুদান বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০১৭ সালে চ্যারিটির এক সভা হয় মালয়েশিয়ায়। সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ২০২০ সালে চ্যারিটি থেকে এই দুই প্রতিষ্ঠানকে আর অনুদান দেওয়া হবে না।

অনুদান বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হওয়ার পর এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ব্যয় নির্বাহ নিয়ে বিপাকে পড়েন মিশন ফাদার ও কর্তৃপক্ষ।

বর্তমানে বরিশাল অক্সফোর্ড মিশনের আওতায় ১০টি প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন ৭৯ জন। তাঁদের বেতন-ভাতা, দাতব্যপ্রতিষ্ঠান পরিচালনাসহ প্রতি মাসে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। আকস্মিক অনুদান বন্ধ করার ঘোষণায় এসব প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। সম্প্রতি সব প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি অভিন্ন তহবিল গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ফাদার এবং মিশন পরিচালনা কর্তৃপক্ষ। এ জন্য সব প্রতিষ্ঠানের অর্থ তুলে এই অভিন্ন তহবিলে স্থানান্তর করা হয়েছে।

মিশনের কনিষ্ঠ ফাদার জন হালদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্রিটিশ অনুদান বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা আসার পর মিশনের প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনার ব্যাপারে আমাদের উদ্বেগ বাড়ছে। এ জন্য আমরা মিশনের সম্পদ থেকে আয়ের নানা উৎস বের করার চেষ্টা করছি। এখন থেকে প্রতিষ্ঠানগুলোর আলাদা তহবিল বিলুপ্ত করে একটি অভিন্ন তহবিল গঠন করে সেখান থেকে সব প্রতিষ্ঠানের ব্যয় নির্বাহের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরই মধ্যে এই অভিন্ন তহবিল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছি আমরা। এ জন্য মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আলাদা তহবিলের অর্থ যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় তুলে অভিন্ন তহবিলে স্থানান্তর করা হয়েছে। এসব অর্থ ব্যাংকে স্থায়ী আমানত হিসেবে রেখে সেই আয় দিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’

মিশনের ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে জ্যেষ্ঠ ফাদার ফ্রান্সিস পান্ডে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মিশনের আওতায় প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েই অভিন্ন তহবিল গঠন করেছি। এ নিয়ে বিভ্রান্তির কোনো সুযোগ নেই। কারণ, মিশনের একটি পয়সাও অপচয় করার সুযোগ নেই।’