স্বর্ণলতা ও শিউলির স্বপ্ন কি থেমে যাবে
বাবাহারা স্বর্ণলতা সুমিকে কম বয়সে এক স্কুলশিক্ষকের সঙ্গে বিয়ে দেন তাঁর মা। কিন্তু মাত্র ছয় মাসে স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয় স্বর্ণলতার। মা মোহসিনা বেগম পাঁচ সদস্যের সংসার নিয়ে দুশ্চিন্তায় এখন অনেকটাই শয্যাশায়ী। সেই স্বর্ণলতা এবার রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘এ’ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে মেধাতালিকায় ৩০তম এবং ‘বি’ ইউনিটে ৩০০তম স্থান অধিকার করেছেন।
শিউলি খাতুন গ্রামের বাচ্চাদের পড়িয়ে নিজের পড়াশোনার খরচ চালিয়েছেন। সেই শিউলি এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ঘ’ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় ১৩৮তম হয়েছেন। এখন ভর্তি হওয়ার টাকা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচ সংগ্রহে অনেকের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন তিনি।
স্বর্ণলতার বাড়ি রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার রাধানগর ইউনিয়নের দিলালপুর সরকারপাড়া গ্রামে। প্রয়াত বাবা এনায়েত হোসেন ছিলেন একটি কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক। চার বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে স্বর্ণলতা চতুর্থ।
স্বর্ণলতার গ্রামের লোকজন জানান, ২০১২ সালে স্বর্ণলতা সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে তাঁর বাবা মারা যান। মা মোহসিনা চার মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে পড়েন মহাবিপদে। স্বামীর রেখে যাওয়া ১ একর ৩০ শতক জমির মধ্যে ৭০ শতক বিক্রি করে বড় দুই মেয়েকে বিয়ে দেন। আর তাঁর বাবার মারা যাওয়ার আগে এক মেয়েকে বিয়ে দিয়ে যান।
অষ্টম শ্রেণিতে জিপিএ-৫ পেলে স্বর্ণলতার প্রতি সুনজর পড়ে স্থানীয় দিলালপুর বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। ২০১৬ সালে টেস্ট পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করলে শুধু বোর্ড ফি নিয়ে ২০১৮ সালে স্বর্ণলতাকে এসএসসি পরীক্ষার সুযোগ করে দেন শিক্ষকেরা। এসএসসি পরীক্ষার সপ্তাহখানেক আগে স্বর্ণলতার টাইফয়েড ধরা পড়ে। এর মধ্যেই পরীক্ষায় অংশ নেন। শেষ পর্যন্ত চতুর্থ বিষয়ের পরীক্ষায় অংশ নিতে না পারলেও বিজ্ঞানে জিপিএ-৪.২২ পান।
এইচএসসি পরীক্ষার আগে স্বর্ণলতার জীবনে নেমে আসে আরেক খড়্গ। তাঁর মা বাকি ৬০ শতক জমির মধ্যে ৩০ শতক বিক্রি করে তাঁকে রংপুর সদরের এক স্কুলশিক্ষকের সঙ্গে বিয়ে দেন। স্বামীর শারীরিক নির্যাতনের কারণে মাত্র ছয় মাসের মাথায় তাঁর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।
স্বর্ণলতা জানান, স্বামীর বাধা সত্ত্বেও তিনি বদরগঞ্জের লালদীঘি পীরপাল কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জিপিএ-৪.৬৭ পান। পরে দিনাজপুরের হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফরম তুলে বাবার বাড়ি থেকে পরীক্ষা দিতে যাওয়ার পথে সৈয়দপুর পৌরশহরের রাস্তায় স্বামী তাঁকে আটক করেন এবং পরীক্ষার কাগজপত্রসহ ব্যাগ কেড়ে নিয়ে পরীক্ষা দিতে নিষেধ করেন। পথচারীরা এগিয়ে এসে তাঁকে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে দিনাজপুরে পাঠিয়ে দেন। তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জি’ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষার মেধাতালিকায় ৭৮তম স্থান অধিকার করেন। কিন্তু স্বামী তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে দেননি।
এসব ঘটনা এই প্রতিবেদকের সঙ্গে বলার সময় ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন স্বর্ণলতা। তিনি বলেন, ‘স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর বাড়িতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর লুকিয়ে লুকিয়ে পড়েছি। পরিবারের বাধা সত্ত্বেও এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে এক হাজার টাকা ধার নিয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি ইউনিটের ফরম তুলে পরীক্ষা দিয়ে দুটিতেই ভর্তির সুযোগ পেয়েছি। বড় তিন বোনের বিয়ে হয়েছে। একমাত্র ভাই খালার বাসায় থেকে কলেজে পড়ছে। বাড়িতে দাদা–দাদি, মা ও আমি। সংসারে আয়ের কোনো পথ নেই। ৩০ শতক জমির ঠিকা দেওয়া ধান দিয়ে কষ্টে সংসার চলে। মা অসুস্থ কাজ করতে পারেন না। দাদা-দাদিও বয়সের ভারে অচল।’
স্বর্ণলতা বলেন, ‘আমি পড়তে চাই। শুনেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে লাগবে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। সেখানে মেসে থাকা–খাওয়ার খরচ লাগবে প্রতি মাসে তিন হাজার টাকা। কিন্তু আমার কোনো উপায় নেই। বিসিএস ক্যাডার হয়ে দেশ ও মানুষের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে চাই। কেউ যদি আমার পড়াশোনার দায়িত্ব নেয়, আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব।’
স্বর্ণলতার মা মোহসিনা বলেন, ‘বেটিটা মোর হতভাগী। পইড়বার (পড়তে) চাইছিল। বিয়াও (বিয়ে) কইরবার চায় নাই। গরিব মানুষ, না দিয়া উপায় আছিল না। জামাইটা আছিল খুব অজাত। খালি মারে। শ্যাষম্যাষ ছাড়াছাড়ি হলো। কেমন করি জানি পরীক্কা দিয়া ভারসিটিত বোলে টিকছে। ফির পইড়বার (পড়তে) চায়। কিন্তুক এক পাইসাও দেওয়ার উপায় নাই মোর।’
শিউলির বাড়ি উপজেলার দামোদরপুর ইউনিয়নের শেখেরহাট নয়াপাড়া গ্রামে। সাত ভাইবোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। বাবা গোলজার হোসেন রিকশাভ্যান চালাতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় অনেকটা পঙ্গু হয়ে শয্যাশায়ী। আবাদি কোনো জমি নেই। বাড়ির পাশে ছোট্ট একটি খিলিপানের দোকান। এটি চালান শিউলির ১৪ বছর বয়সের ছোট ভাই ইমরান হোসেন। এই দোকানের আয়ে চলে তাঁদের সংসার। তাঁর তিন বোনের বিয়ে হয়েছে। বর্তমানে পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছয়।
শিউলি ২০১৭ সালে স্থানীয় শেখেরহাট উচ্চবিদ্যালয়ে এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৪.৫৯ এবং চলতি বছর বদরগঞ্জ মহিলা ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসিতে বাণিজ্যে জিপিএ-৪.৫৮ পান।
শিউলি বলেন, ‘অভাবের কারণে আমার কোনো ভাইবোন পড়াশোনা করতে পারেনি। শত অভাব–অনটন ও বাধা সত্ত্বেও বাচ্চাদের প্রাইভেট পড়িয়ে পড়াশোনা করে এত দূর এসেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বড় ভাই জানিয়েছেন, সেখানে ভর্তির সময় যাবতীয় খরচ লাগবে প্রায় ২৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া প্রতি মাসে থাকা–খাওয়ায় খরচ পড়বে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা। এক হাজার টাকা দেওয়ারও উপায় নেই আমার পরিবারের। কেউ সাহায্যের হাত না বাড়ালে পড়াশোনার পথ চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু আমি থেমে যেতে চাই না।’
শিউলির বাবা গোলজার বলেন, ‘মুই তো অচল। বেটিটা পইড়বার চায়। মুই চাও অয় (শিউলি) পড়া বাদ দেউক। কারণ, মোর ১০০ টাকা খরচ করারও উপায় নাই।’
বদরগঞ্জ মহিলা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ বিমলেন্দু সরকার বলেন, ‘শিউলি মেধাবী মেয়ে। আমরা তাঁকে কলেজে পড়ার সময় সহযোগিতা করেছি।’
সহায়তার হাতে বাড়াতে চাইলে যোগাযোগ করুন।
স্বর্ণলতা: বিকাশ নম্বর ০১৭৮৭৯৮৪৮৯৯
শিউলি: ডাচ-বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং ৭০১৭৫১৮৪৪৯৭২৫ নম্বর (রকেট) অ্যাকাউন্ট। মুঠোফোন-০১৭৮৩১৮৪২২৯ (বিকাশ)