জেলে পরিবারগুলোতে স্বস্তি

চলতি বছরে তিন দফা বন্ধ ছিল সুন্দরবনের নদ–নদীতে মাছ ও কাঁকড়া আহরণ। ফলে কাজ ছাড়া কয়েক মাস কেটেছে জেলেদের। বন বিভাগ ১৪ নভেম্বর থেকে স্থানীয় জেলেদের ফের মাছ ধরার অনুমতি দিয়েছে। এতে জেলেদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে।

শ্যামনগর উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা ফারুক হোসেন জানান, ২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী শ্যামনগর উপজেলায় সুন্দরবনভিত্তিক নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ২৩ হাজার ১৭৮। প্রায় সারা বছরের আয়–উপার্জনের একমাত্র ক্ষেত্র বঙ্গোপসাগর–তীরবর্তী সুন্দরবনসংলগ্ন নদ-নদীতে মাছ ও কাঁকড়া শিকার। 

পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জ সূত্রে জানা যায়, জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি দুই মাস সুন্দরবনে জেলেদের ঢোকা বন্ধ ছিল। পরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ১৯ জুলাই থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সব ধরনের মাছ ও কাঁকড়া ধরা নিষিদ্ধ করা হয়। ইলিশ সংরক্ষণের জন্য গত ৯ অক্টোবর থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত জেলেদের সুন্দরবনে প্রবেশ নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি মাছ ও কাঁকড়া ধরা বন্ধ রাখা হয়। 

জেলেরা বলেন, আগের বছরগুলোতে কেবল জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে সুন্দরবনের খাল বা নদ-নদীতে মাছ ধরা বন্ধ রাখা হতো। এই বছর আরও দুই দফায় কয়েক মাস মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়। এই কারণে কয়েক মাস তাঁদের বেকার থাকতে হয়েছে। ধার করে চলেছে অনেকের সংসার। আগামী কয়েক মাস মাছ ধরতে পারলে তাঁরা হয়তো কিছু দেনা পরিশোধের সুযোগ পাবেন। 

সুন্দরবনসংলগ্ন দাতিনাখালী এলাকার আবদুস সোহবান গাজী বলেন, সুন্দরবনসংলগ্ন নদ-নদীতে কোনো ইলিশ থাকে না। কিন্তু ইলিশের প্রজননের সময় এখানে মাছ ধরা বন্ধ রাখা হয়েছে। অন্য জেলায় ইলিশ প্রজননের মৌসুমে জেলেদের সরকারি বিশেষ প্রণোদনা দেওয়া হয়। কিন্তু তাঁদের কোনো ধরনের প্রণোদনা দেওয়া হয়নি। মাছও ধরতে দেওয়া হয়নি। ফলে এ এলাকার জেলে পরিবারগুলো আর্থিক সংকটে পড়েছে। 

জেলেরা জানান, নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ২৩ হাজার ১৭৮ হলেও এই এলাকায় ৫০ হাজার জেলে আছে। কয়েক মাস মাছ ও কাঁকড়া ধরা বন্ধ থাকায় সবাই পড়েছে আর্থিক সংকটে। উপরন্তু বুলবুলের আঘাতে অনেক জেলের ঘরবাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে।

সুন্দরবন–তীরবর্তী মথুরাপুর জেলেপল্লির গৃহবধূ মনসা মণ্ডল জানান, স্বামীর একার উপার্জনে সংসার চলে না। তাই তাঁকেও সুন্দরবনে যেতে হয় মাছ ও কাঁকড়া শিকারে। কিন্তু এ বছর বিভিন্ন কারণে তিন দফায় সুন্দরবনে মাছ শিকার বন্ধ করে দেওয়া হয়। চার মাস পর সুন্দরবনের নদ-নদীতে মাছ ও কাঁকড়া ধরার অনুমতি মেলায় তিনি আশায় বুক বেঁধেছেন। আবার হয়তোবা ফের ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন।

কদমতলা ফরেস্ট অফিসসংলগ্ন গ্রামের জেলে ফজের আলী মোল্লা বলেন, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি কাঁকড়ার প্রজনন মৌসুমের কারণে সুন্দরবনে সব ধরনের মাছ ও কাঁকড়া ধরা বন্ধ রাখা হয়। তারপর কিছু সময় বাদ দিয়ে জুলাই থেকে ১৩ নভেম্বর নানা কারণ দেখিয়ে বন্ধ রাখা হয়েছিল। জেলেরা যদি ছয় মাস বেকার থাকেন, তাহলে তাঁদের অর্ধাহারে–অনাহারে থাকা ছাড়া উপায় থাকে না। ১৪ নভেম্বর থেকে সুন্দরবনে ঢোকার অনুমতি মেলায় তাঁরা কিছুটা হলেও আশ্বস্ত হয়েছেন। 

সুন্দরবনসংলগ্ন শ্যামনগরের মাথুরাপুর জেলেপল্লি, সাধুপাড়া জেলেপল্লি, নেবুবনিয়া জেলেপল্লি, মুন্সিগঞ্জ জেলেপল্লি, কদমতলা জেলেপল্লির পরিবারগুলো চরম আর্থিক সংকটে পড়েছে। কদমতলা জেলেপল্লির বাসিন্দা হরশিদ মণ্ডল জানান, দু-চার দিনের মধ্যে তাঁরা সুন্দরবনে ঢুকবেন মাছ ও কাঁকড়া আহরণে। যাঁরা ১৪ নভেম্বর থেকে সুন্দরবনে ঢুকেছেন, তাঁরা মাছ পাচ্ছেন না বলে তাঁকে জানিয়েছেন। এরপরও তাঁরা আশায় বুক বেঁধে আছেন সুন্দরবন থেকে মাছ ও কাঁকড়া ধরে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন। 

সুন্দরবন রেঞ্জের সাতক্ষীরার বুড়িগোয়ালিনী স্টেশন কর্মকর্তা আক্তারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ১৪-১৯ নভেম্বর পর্যন্ত ২৫০-৩০০টি অনুমতিপত্র দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি অনুমতিপত্র নিয়ে পাঁচ-ছয়জন জেলে সুন্দরবনে ঢোকেন। একইভাবে সাতক্ষীরা রেঞ্জের কৈখালি, কবাদক ও কদমতলা স্টেশন থেকে সমপরিমাণ অনুমতিপত্র দেওয়া হয়।