তালিকা তৈরিতে অনিয়ম

জনশূন্য ঘর দেখিয়ে লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের প্রস্তাবের তালিকা প্রস্তুত করেছে মাদারীপুর জেলা প্রশাসন ও গণপূর্ত বিভাগ। গতকাল শিবচর উপজেলার কুতুবপুর এলাকায়।  ছবি: প্রথম আলো
জনশূন্য ঘর দেখিয়ে লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের প্রস্তাবের তালিকা প্রস্তুত করেছে মাদারীপুর জেলা প্রশাসন ও গণপূর্ত বিভাগ। গতকাল শিবচর উপজেলার কুতুবপুর এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

ঘরে নেই দরজা-জানালা। নেই বিদ্যুৎ-সংযোগও। সেখানে থাকেন না কেউ। কাটা হয়েছে পুকুর। ছয় মাস আগেও এসব বাড়িঘর এখানে ছিল না। মাদারীপুরের শিবচর উপজেলায় শেখ হাসিনা তাঁতপল্লি নির্মাণের জন্য প্রস্তাবিত জমিতে এসব স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। অথচ এসব স্থাপনার জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

অভিযোগ উঠেছে, সরকারের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিতে দালালদের সঙ্গে যোগসাজশ করে জেলা প্রশাসনের ভূমি হুকুমদখল (এলএ) শাখা ও গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তারা এ ক্ষতিপূরণের তালিকা তৈরি করেছেন।

জেলা প্রশাসনের সূত্র জানায়, মাদারীপুরের কুতুবপুরের ৬০ একর এবং শরীয়তপুরের নাওডোবার ৬০ একর জমিতে সরকার শেখ হাসিনা তাঁতপল্লি নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। এই তাঁতপল্লি নির্মাণের জন্য প্রস্তাবিত খালি জমির ওপর শত শত গাছপালা রোপণ ও নতুন ঘরবাড়ি তুলে সরকারের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার পাঁয়তারা করে স্থানীয় একটি চক্র। বিষয়টি স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জেলা প্রশাসনের নজরে এলে তারা ওই স্থাপনাগুলো গুঁড়িয়ে দেয়। তবে স্থাপনা ভেঙে দেওয়ার পরে রাতের আঁধারে আবার নির্মাণ করা হয় ঘরবাড়ি। কাটা হয় পুকুরও। 

গতকাল রোববার সরেজমিনে দেখা গেছে, শেখ হাসিনা তাঁতপল্লির জন্য প্রস্তাবিত এলাকায় অসংখ্য ছোট-বড় টিনশেড ঘর। কিন্তু এসব ঘরে কেউ থাকে না। ঘরগুলোতে বিদ্যুৎ–সংযোগও নেই। আশপাশে কোনো লোকজনও নেই। পুকুরের সামনে মাছ চাষের বড় বড় সাইনবোর্ড লাগানো আছে। কিন্তু সেখানে কোনো মাছ নেই। ওই এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে চারাগাছের একাধিক নার্সারি। 

জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা ও গণপূর্ত বিভাগ জানায়, শিবচর উপজেলার কুতুবপুর ৯২ নম্বর দাগে একটি মৌজায় শেখ হাসিনা তাঁতপল্লি
নির্মাণের প্রথম ধাপে ২২টি পরিবারকে ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে উল্লেখ করে তালিকা তৈরি করেন জেলা প্রশাসনের এলএ শাখার সার্ভেয়ার (জরিপকারী) সোহেল মিয়াজী ও মোস্তাফিজুর রহমান। পরে এই পরিবারগুলোর বিভিন্ন স্থাপনা বাবদ ৩ কোটি ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রস্তাব করে গণপূর্ত বিভাগ। পরে আরও পাঁচটি পরিবারকে এই তালিকায় যুক্ত করে এলএ শাখা । 

ইতিমধ্যে এসব পরিবারকে ৭ ধারায় নোটিশ দিয়েছে ভূমি অধিগ্রহণ শাখা। ৮ ধারায় নোটিশ দিলে পরিবারগুলো প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখিয়ে এই ক্ষতিপূরণের পুরো টাকা উত্তোলন করতে পারবে এলএ শাখা থেকে। ক্ষতিপূরণের এসব বিল দেওয়ার প্রস্তাব দেন জেলার গণপূর্ত বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী শাহরিয়ার হোসেন, মো. জোবায়ের, উপসহকারী প্রকৌশলী মো. রাজীব আহম্মেদ তরফদার, মো. মাসুম বিল্লাহ, মো. আবদুস সাত্তার খান।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ক্ষতিপূরণ পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে আবদুস সালাম মুন্সীকে প্রায় ৩০ লাখ টাকা, ইব্রাহীম খাঁকে ২৬ লাখ টাকা, সিরাজুল খানকে ২১ লাখ, তাঁরা মিয়া ও রাসেল আহম্মেদকে ১ লাখ ৬২ হাজার টাকা করে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া বিদ্যুতের জন্য ওই ২২টি পরিবারকে ১৬ লাখ টাকা দিতে প্রস্তাব করেন গণপূর্ত বিভাগের ওই পাঁচ কর্মকর্তা।

অভিযোগ উঠেছে, সরকারের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিতে একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে এ কার্যক্রম করে আসছে। একশ্রেণির দালাল ও অসাধু জমির মালিকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তারা এসব স্থাপনার জন্য কোটি কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ চেয়ে তালিকা প্রস্তুত করেছেন। 

স্থানীয় এক বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘কয়েক দিন আগে ঘরগুলো একে একে তোলা হয়। তবে তখন আমরা বুঝতে পারিনি এর কারণ কী। এখন শুনেছি, সরকার এই জমি কিনে নেবে। তার জন্য ক্ষতিপূরণের টাকা কয়েক গুণ নিতে এসব ঘর স্থাপনা করা হয়। তবে এখন যেসব ঘর বা পুকুর দেখছেন, ছয় মাস আগে এর কিছুই ছিল না।’

এই ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারে তালিকায় থাকা আবদুস সালাম মুন্সী বলেন, ‘২০১৬ সালে আমি ঘর ও পুকুর নির্মাণ করি। সেই হিসেবে আমি ৭ ধারা নোটিশ পেয়েছি। ওই মৌজায় শুধু আমার ঘরটিই পুরোনো।’

সচেতন নাগরিক কমিটির মাদারীপুর জেলা শাখার সদস্য এনায়েত হোসেন বলেন, শেখ হাসিনা তাঁতপল্লি নির্মাণের জন্য প্রস্তাবিত খালি জমিতে নতুন ঘরবাড়ি তুলে বাড়তি টাকা নিতে একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে যোগসাজশ করছে। প্রশাসনের কাছে একটাই দাবি, প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা যেন জমি ও স্থাপনার সঠিক মূল্য পান। আর প্রতারকদের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে আইনের আওতায় আনা হোক।

গণপূর্ত বিভাগ মাদারীপুর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু সালেহ মুহাম্মদ ফিরোজ বলেন, তালিকা জেলা প্রশাসন থেকে প্রস্তুত করে তাঁদের কাছে পাঠায়। পরে তাঁরা সরেজমিনে গিয়ে বিস্তারিত জেনে চূড়ান্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিল প্রস্তাব করেন। গণপূর্ত বিভাগ যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে প্রতিটি কাজ করে। এখানে দুর্নীতি হওয়ার সুযোগ নেই। তবু এ বিষয় নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তাঁরা বিষয়টি দেখবেন।

জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুল ইসলাম জানান, গণপূর্ত বিভাগের সঙ্গে যৌথ তদন্ত করে ক্ষতিপূরণের বিল দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। বিল কম দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই, তেমনি বিল বেশি দেওয়ারও সুযোগ নেই। তবে অনিয়ম হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না।

জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ ও মাদারীপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য নুর-ই-আলম চৌধুরী বলেন, তাঁতপল্লি নির্মাণের জন্য নির্ধারিত স্থানে পুরোনো স্থাপনা থাকার কথা নয়। এ ক্ষেত্রে বাড়তি বিল দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে কি না, বিষয়টি যাচাই-বাছাই করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।