ঢাকার গাছপালাও বড় বিপদে

বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি বিপদে আছে ঢাকা শহরের রাস্তার ধারের গাছপালা। ছবি: আবদুস সালাম
বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি বিপদে আছে ঢাকা শহরের রাস্তার ধারের গাছপালা। ছবি: আবদুস সালাম

ঢাকা শহরে দূষণ যেমন বাড়ছে, তেমনি তা মোকাবিলার রক্ষাকবচ সবুজ গাছপালাও কমে আসছে। এবার কোনোরকমে টিকে থাকা সেই সবুজের জন্য নতুন বিপদের কথা শোনালেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা বলছেন, যানবাহনের ক্ষতিকর গ্যাস ও অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার দূষণের মাত্রা এতটাই যে ঢাকা শহরের গাছপালা টিকে থাকার ক্ষমতা হারাচ্ছে। যতটুক সবুজ টিকে আছে, তা–ও এ দূষণে কত দিন বেঁচে থাকবে, তা নিয়ে আছে আশঙ্কা।

বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি বিপদে আছে ঢাকা শহরের রাস্তার ধারের গাছপালা। এসব গাছের টিকে থাকার ক্ষমতা স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে ৩০ শতাংশ কমে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন এবং উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের যৌথ গবেষণায় এই তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

গবেষণা নিবন্ধটি গত ১২ অক্টোবর আন্তর্জাতিক প্রকাশনা স্প্রিঙ্গার নেচার অ্যাপ্লাইড সায়েন্সেস জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষকেরা বলছেন, গাছের সংবেদনশীলতার মাত্রা নিয়ে এমন গবেষণা দেশে এটিই প্রথম। যানবাহনের দূষণে ঢাকা শহরের গাছপালার সংবেদনশীলতা কতটা বিনষ্ট হচ্ছে, তা নিয়েই মূলত গবেষণাটি হয়েছে। 

গবেষণায় দেখা গেছে, শহরের দেবদারু, মেহগনি ও কাঁঠালগাছের ওপর যানবাহন থেকে নিঃসৃত নাইট্রোজেন ডাই–অক্সাইড গ্যাস ও অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার (পিএম ২ দশমিক ৫) ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে।

গবেষকেরা বলছেন, গাছের পাতার পৃষ্ঠগুলো বাতাসের অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা, সালফার ডাই–অক্সাইড, নাইট্রোজেনের অক্সাইড ও কার্বন ডাই–অক্সাইডসহ দূষণকারী উপাদান শোষণ করে। এসব উপাদান শোষণে গাছের পত্ররন্ধ্রের বড় ভূমিকা থাকে। বাতাসে থাকা কার্বন ডাই–অক্সাইড শোষণের পাশাপাশি মাটি থেকে পানি নিয়ে সূর্যের আলো ও ক্লোরোফিলের উপস্থিতিতে সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় গাছ খাদ্য তৈরি করে এবং অক্সিজেন ছাড়ে। এই অক্সিজেন নিয়ে প্রাণী বেঁচে থাকে। 

বায়ুদূষণের কবলে পড়ে গাছ কীভাবে টিকে থাকার ক্ষমতা হারাচ্ছে, এ প্রশ্নের উত্তরে গবেষক দলের সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন উদাহরণ দিয়ে বললেন, বেশ কিছুদিন কালো ছাতা ব্যবহার করলে একপর্যায়ে তা বিবর্ণ হয়ে পড়ে। তেমনি দূষণে গাছের সহনশীলতাও ধীরে ধীরে কমতে থাকে। বাতাসে নাইট্রোজেন ডাই–অক্সাইড ও অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণ বেড়ে গিয়ে তা গাছের মোট ক্লোরোফিল কমাতে বড় ভূমিকা রাখে। এই ক্লোরোফিল ছাড়া গাছ খাবার তৈরি করতে পারে না। আবার গাছের পত্ররন্ধ্র খোলা ও বন্ধ হওয়ার প্রক্রিয়াটিও অচল করে দেয় অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা। এর ফলে সালোক সংশ্লেষণের হার কমে যায়। ব্যাহত হয় গাছের বৃদ্ধি ও ফলন। আবার সালফার ডাই–অক্সাইড পানির সঙ্গে মিশে সালফিউরিক অ্যাসিড তৈরি করে, যা ক্লোরোফিলের প্রধান উপাদান ম্যাগনেশিয়ামকে সরিয়ে দিতে পারে। এর ফলে পাতা বিবর্ণ হতে থাকে। গাছের পাতার আকার, আকৃতিরও পরিবর্তন ঘটে। ফুল-ফল ধারণক্ষমতা আস্তে আস্তে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একপর্যায়ে গাছ মারা যায়। তবে এগুলো দু-এক দিনের বিষয় নয়, দীর্ঘমেয়াদি দূষণের ফলাফল।

বৈশ্বিক বায়ুদূষণের ঝুঁকিবিষয়ক প্রতিবেদন ‘দ্য স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার-২০১৯’–এর তথ্য অনুযায়ী, বায়ুদূষণজনিত রোগে ২০১৭ সালে বাংলাদেশে ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষ মারা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইনস্টিটিউট অব হেলথ ম্যাট্রিকস অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন এবং হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউটের যৌথ উদ্যোগে করা প্রতিবেদনটি চলতি বছরের ৩ এপ্রিল প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বায়ুদূষণে মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ পঞ্চম। আর গত ৩ মার্চ বিশ্বের বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এয়ারভিজ্যুয়ালের ‘বিশ্ব বায়ুমান প্রতিবেদন ২০১৮’ অনুযায়ী, বিশ্বে সবচেয়ে বায়ুদূষণের কবলে থাকা রাজধানী শহরগুলোর তালিকায় ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। ঢাকা শহরের বাতাসে ক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বেঁধে দেওয়া মাত্রার চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি। 

দূষণে টিকে থাকার ক্ষমতা কমছে গাছের
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দল ২০১৭–১৮ সালের গ্রীষ্ম (মার্চ–মে), বর্ষা (জুন–সেপ্টেম্বর) এবং শীতকালে (নভেম্বর–ফেব্রুয়ারি) ঢাকা শহরের তিন ধরনের এলাকা থেকে দেবদারু, মেহগনি ও কাঁঠালগাছের পরিপক্ব পাতা সংগ্রহ করে। এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে ফার্মগেট ও গুলশানের ব্যস্ত সড়কের পাশে, উত্তরা ও ধানমন্ডির আবাসিক এলাকা এবং বোটানিক্যাল গার্ডেন।

দূষণরোধে গাছ কতটা সংবেদনশীল, তা নির্ভর করে বায়ুদূষণ সহনশীলতা সূচকের (এপিটিআই) ওপর। এপিটিআই ১২–এর চেয়ে কম বা সমান হলে গাছের সংবেদনশীলতা ঝুঁকির মুখে পড়ে। অর্থাৎ দূষণে এমন গাছের সহনশীলতা কমে আসে। গবেষকেরা দেখেছেন, গ্রীষ্ম ও বর্ষায় গাছের এপিটিআই যথাক্রমে ৭ দশমিক ৩৪ এবং ৮ দশমিক ১০। অর্থাৎ এই দুই মৌসুমে দূষণে গাছের টিকে থাকার ক্ষমতা কিছুটা কম। তবে শীতকালে তা আরও কমে আসে (৬ দশমিক ৬৯)। যানবাহনের দূষণে আবাসিক ও নিয়ন্ত্রিত স্থানের (বোটানিক্যাল গার্ডেন) তুলনায় রাস্তার ধারের গাছের টিকে থাকার ক্ষমতা সবচেয়ে কম পেয়েছেন গবেষকেরা। 

গবেষক দলের প্রধান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, দূষণরোধে ঢাকায় সবুজ অঞ্চল বা জলাধারের পরিমাণও কম। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে গত তিন দশকে শহরে ভূ–উপরিস্থিত পানি, জলাশয় ও সবুজ গাছপালা কমে দূষণ বেড়েছে। ইট–পাথরের নির্মাণ, রাস্তা মেরামত ও খোঁড়াখুঁড়ির মতো কাজগুলো সঠিক ব্যবস্থাপনার আওতায় না হওয়ায় এই দূষণ আরও বাড়ছে। এই কাজগুলো একেক সংস্থা একেকভাবে করছে। নগর ব্যবস্থাপনায় এ সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় দরকার। সমস্যা জানা আছে, সমাধানও জানা আছে। কিন্তু দূষণরোধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেই।

বিলুপ্ত হচ্ছে সবুজ, বাড়ছে দূষণ
ঢাকা শহরে সবুজ অঞ্চল কতটা রয়েছে, তা নিয়ে গবেষণা করেছেন জাপানের কিয়োটো ও হোক্কাইডো বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন গবেষক। স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৯২টি ওয়ার্ডে পরিবেশের মান নিয়ে করা এই গবেষণা প্রতিবেদনটি গত জানুয়ারিতে যুক্তরাজ্যভিত্তিক পেশাজীবী সংগঠন দ্য ইনস্টিটিউট অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ার্সের আইসিই জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। 

গবেষক দলের সদস্য রাজউকের সহকারী পরিকল্পনাবিদ ও হোক্কাইডো বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত মুস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৯৫ সালে ঢাকার সবুজ অঞ্চল ছিল মোট আয়তনের ১২ শতাংশ। ২০১৫ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৮ শতাংশে। বর্তমানে শহরে সবুজ অঞ্চল ৬–৭ শতাংশের বেশি হবে না।

বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে জলাশয়েরও বড় ভূমিকা রয়েছে। অথচ অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে ভরাট হচ্ছে জলাশয়, নিচু ভূমি, খাল ও নদী। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ) নির্ধারিত জলাভূমির ২২ শতাংশ ২০১৯ সালের জানুয়ারির মধ্যে ভরাট হয়ে গেছে। আর এ বছর মার্চে প্রকাশিত পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকার বায়ুদূষণের ৫৮ শতাংশ উৎস এখনো শহরের ইটভাটা। আর রাস্তা ও মাটির ধুলা এবং মোটরগাড়ির দূষণ মিলে প্রায় ২৬ শতাংশ। 

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, উন্নয়নের নামে ঢাকাসহ বেশির ভাগ বড় শহরকে বৃক্ষশূন্য করে ফেলা হয়েছে, হচ্ছে। যতটুকু গাছপালা আছে, তা–ও যদি টিকে থাকার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, তাহলে এই শহরে বসবাস করাই কঠিন হয়ে যাবে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য তাঁর পরামর্শ, স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুরো শহরে ব্যাপক আকারে বৃক্ষরোপণর দায়িত্ব দিতে হবে। তা না হলে ঢাকা শহরে বৃক্ষ কিংবা মানুষ কেউ টিকবে না।