এক শিশুসন্তানের শোক কাটতে না কাটতেই আরেকটি খুন

নিহত সানি। ছবি: সংগৃহীত
নিহত সানি। ছবি: সংগৃহীত

শিশুটির বয়স মাত্র পাঁচ বছর। নাম মোহাম্মদ সানি। রাজধানী গুলিস্তানের বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের তিন নম্বর গেটে মায়ের সঙ্গে সে থাকত। ১৬ দিন আগে গত ৯ নভেম্বর রাত নয়টার দিকে নিখোঁজ হয় সানি। মা ঝর্ণা বেগমসহ আত্মীয়স্বজন অনেক খোঁজাখুঁজি করে সানিকে পায়নি। পরদিন ১০ নভেম্বর রাত ১০টার দিকে গুলিস্তানের অলিম্পিক ভবনের সামনের পুলিশ বক্সের পাশের একটি ফুলগাছের টবের পাশে সানির বস্তাবন্দী লাশ পাওয়া যায়। সেখানে পাওয়া যায় একখানা চিরকুট। তাতে লেখা, ‘চান মিয়া ঝর্ণার পোলা মেরে ফেলেছে। ২০ হাজার বছর জেল।’

চিরকুটে লেখা চান মিয়া সম্পর্কে নিহত সানির খালু।

সানি খুন হওয়ার পাঁচ মাস আগে তার ছোট ভাই বাহারকে (২) চুরি করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।

পল্টন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বকর সিদ্দিক আজ সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, নৃশংসভাবে সানিকে খুন করে লাশ বস্তাবন্দী অবস্থায় ফেলে যায় দুর্বৃত্তরা। সানি খুনে জড়িত থাকার সন্দেহে ইতিমধ্যে তাঁরা মো. রাসেল ওরফে ন্যাংড়া রাসেল (৩২) ও রফিকুল ইসলাম ওরফে পিন্টু (৩২) নামের দুজনকে গ্রেপ্তার করেছেন। রিমান্ডে নিয়ে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। রাসেলের বাড়ি ডেমরার কোনাপাড়ার আল আমিন রোডে। তাঁর বাবার নাম দিদার হোসেন। আর রফিকুলের বাড়ি বরগুনার আমতলী থানার মোষখালী গ্রামে। তাঁর বাবার নাম আবু হানিফ।

চুরি যাওয়া ছোট্ট শিশু বাহার। ছবি: সংগৃহীত
চুরি যাওয়া ছোট্ট শিশু বাহার। ছবি: সংগৃহীত

সানি খুনের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পল্টন থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রেজাউল করিম খান প্রথম আলোকে বলেন, সানি খুনের জড়িত থাকার অভিযোগ যে ছয়জনের বিরুদ্ধে, তাঁরা সবাই মাদকের ব্যবসায় জড়িত বলে জানা গেছে। দুজন ধরা পড়লেও বাকি চারজন এখনো পলাতক। রেজাউল করিম জানান, সানি খুন হওয়ার পাঁচ মাস আগে তার ছোট ভাই বাহারকে চুরি করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।

পল্টন থানা-পুলিশ এবং শিশু সানির পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সানির বাবার নাম সাগর শেখ। বছর দেড় আগে ভ্রাম্যমাণ আদালত তাঁকে দুই বছর কারাদণ্ড দেন। সানির মা ঝর্ণা বেগম সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, স্বামী জেলে যাওয়ার পর তিনি স্টেডিয়াম এলাকার বিভিন্ন দোকানে পানি সরবরাহের কাজ করে সংসার চালান। তিন ছেলেকে নিয়ে স্টেডিয়াম এলাকার ঝুপড়ি ঘরে থাকতেন। তার বড় ছেলের নাম ইয়াছিন (৭), মেজ ছেলে সানি (৫) আর ছোট ছেলে বাহার (২)। পাঁচ মাস আগে জুন মাসের কোনো একদিন ছেলেদের নিয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন তিনি। ঘুম থেকে উঠে দেখেন তাঁর ছোট ছেলে বাহার নেই। নিখোঁজ বাহারকে আর খুঁজে পাননি তিনি। থানায় মামলাও করেছেন। ছোট ছেলের চিন্তায় যখন ঘুম হারাম, তখন তাঁর মেজ ছেলে সানিও খুন হয়। কারও সঙ্গে ঝর্ণা বেগমের কোনো শত্রুতা নেই। তবে তাঁর ধারণা, যারা সানিকে খুন করেছে, তাদের সঙ্গে তাঁর ভগ্নিপতি চান মিয়ার শত্রুতা ছিল।

মা ঝর্ণা বেগম। ছবি: সংগৃহীত
মা ঝর্ণা বেগম। ছবি: সংগৃহীত

সানির মা বলেন, ‘পাঁচ মাসের মাথায় আমি আমার দুই ছেলেকে হারালাম। আমার নিষ্পাপ ছেলে সানিকে যারা খুন করল তাদের ফাঁসি চাই। আমি বিচার চাই।’

সানি খুনের এজাহারে বর্ণনায় গুলিস্তান এলাকার ন্যাংড়া রাসেল, পিন্টু, টুপি জুয়েল, কালাম, পায়েল ও হিরার নাম উল্লেখ করেছেন বাদী ঝর্ণা বেগম। দুই আসামি ন্যাংড়া রাসেল ও পিন্টু গত ১৩ নভেম্বর ধরা পড়েন।

তদন্ত কর্মকর্তা রেজাউল করিম খান বলেন, সানির খালু চান মিয়া পুলিশের সোর্স হিসেবে মাঝেমধ্যে কাজ করতেন। চান মিয়ার সঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া আসামি ন্যাংড়া রাসেলদের দ্বন্দ্ব ছিল। ল্যাংড়া রাসেলরা গুলিস্তানে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

সানির খালু চান মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ৫ নভেম্বর ন্যাংড়া রাসেল এক নারী মাদক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে পুলিশের নাম করে পাঁচ শ টাকা আদায় করেন। এই খবর তিনি থানা-পুলিশকে জানান। ন্যাংড়া রাসেল এই খবর পাওয়ার তাঁকে নানাভাবে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল।

চান মিয়ার দাবি, যে পুলিশ বক্সের পাশে সানির লাশ পাওয়া যায়, সেখানে তিনি একসময় রাতে পরিবার নিয়ে থাকতেন। যারা খুন করেছে তারা ফাঁসানোর জন্য সানির জামার পকেটে তাঁর নাম লিখে একটা চিরকুট রেখে যায়। যাতে পুলিশ সানিকে খুন করার জন্য তাঁকে সন্দেহ করে।

পল্টন থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিক বলেন, সানির খালু চান মিয়া গুলিস্তানে ভাসমান। মাঝেমধ্যে পুলিশকে তথ্য দিয়ে হয়তো সহায়তা করে থাকেন। আবার ন্যাংড়া রাসেলসহ অন্যরাও ভাসমান। গুলিস্তানের ভাসমান এসব লোকজন বিচ্ছিন্নভাবে পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করে থাকতে পারেন।

পল্টন থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিক বলেন, গুরুত্ব সহকারে সানি খুনের মামলাটি তদন্ত করা হচ্ছে। কেন এবং কী কারণে সানিকে খুন করা হলো তা দ্রুত বের করা হবে।