সেলুলয়েডে ঘরবসতি

শৈবাল চৌধুরীর ভূমিকম্পের পরে চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য।  সংগৃহীত
শৈবাল চৌধুরীর ভূমিকম্পের পরে চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য। সংগৃহীত

মুষ্টিমেয় হলেও চট্টগ্রামে শিল্পোত্তীর্ণ চলচ্চিত্র বা সুস্থ ধারার ছবির দেখার দর্শক তৈরি হয়েছে। এ কারণে ভালো সিনেমা মুক্তি পেলে এই শহরে এখনো একশ্রেণির দর্শক ছুটে যান প্রেক্ষাগৃহে। কিন্তু গত এক থেকে দেড় দশকে চট্টগ্রামে প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা ১৪-১৫টি থেকে কমতে কমতে ৩–এ এসে ঠেকেছে। একটা সিনেপ্লেক্সের কথা বাদ দিলে বাকি প্রেক্ষাগৃহগুলোর প্রদর্শনের পূর্ণাঙ্গ আয়োজন নেই। সেই অসুবিধা সত্ত্বেও থেমে নেই ভালো চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী। প্রদর্শনের বিকল্প স্থান ঠিকই তৈরি হয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের অস্কার পাওয়া কিংবা ফ্রান্সের কানে পাম দ’র জেতা হালের চলচ্চিত্রও দেখার সুযোগ মিলছে চট্টগ্রামের দর্শকদের। ইউটিউব বা টেলিভিশনে নয়, বড় পর্দায় প্রদর্শিত হচ্ছে বিখ্যাত সব চলচ্চিত্র। এত বাধাবিপত্তির মধ্যে এটা সম্ভব হলো কী করে, এমন প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য বিশদ করে বলার প্রয়োজন নেই। এক-দুই কথায় বলা যায়, কৃতিত্বটা চট্টগ্রামের চলচ্চিত্র সংগঠনগুলোর।

স্বাধীনতার পর থেকে চট্টগ্রামে যে কয়টা চলচ্চিত্র সংগঠন গঠিত হয়েছে, তার মধ্যে চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্র সবচেয়ে ক্রিয়াশীল এবং এখনো সমানতালে কাজ করে যাচ্ছে। ১৯৯৩ সালের ১ জানুয়ারি যাত্রা শুরুর পর নিয়মিত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব করছে চলচ্চিত্র কেন্দ্র। বাংলাদেশ, ভারত, জাপান, কোরিয়া, ইরান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ পৃথিবীর নানা দেশের খ্যাতনামা চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সৃষ্টি নিয়ে আলাদা প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে সংগঠনটি। প্রকাশিত হয়েছে চলচ্চিত্রবিষয়ক পত্রিকা নিউওয়েভ ও চিত্রকৃতি। এ ছাড়া নিয়মিত চলচ্চিত্রবিষয়ক কর্মশালা, পাঠচক্র ও সেমিনার আয়োজন করে সংগঠনটি। এসবের পাশাপাশি এই সংগঠনের বর্তমান ও সাবেক সদস্যরাও স্বল্পদৈর্ঘ্য, পূর্ণদৈর্ঘ্য ও প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন।

সম্প্রতি কথা হয় সংগঠনের পরিচালক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা শৈবাল চৌধুরীর সঙ্গে। জানতে চাই সংগঠনের শুরু কথা। কোন প্রেক্ষাপটে, কেনই–বা এমন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হলেন তাঁরা।

সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা শৈবাল নিজে চলচ্চিত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত স্কুলজীবন থেকে। বলতে গেলে এক জীবন পুরো চলচ্চিত্র নিয়েই কাটিয়ে দিয়েছেন। চলচ্চিত্র কেন্দ্র শুরুর প্রেক্ষাপট তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বেশ পেছনে ফিরে গেলেন। তাঁর মতে, চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্র হঠাৎ করে গঠিত হয়নি। আসলে এর প্রস্তুতি চলছিল স্বাধীনতার পর থেকেই।

বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সাহিত্যিক আবুল ফজল ছিলেন নগরের প্রথম চলচ্চিত্র সংগঠন চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র সংসদের সভাপতি। তখন এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হন মৃণাল সরকার, আবুল মোমেন, আবুল মনসুর, শাহেদ আজগর চৌধুরী, আনোয়ার হোসেন পিন্টু, ইকবাল করিম হাসনু, ফরিদুল হক, শাহাদুজ্জামান, শৈবাল চৌধুরীসহ অনেকে। চলচ্চিত্র সংসদ সক্রিয় ছিল ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত। তখন চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে সংগঠনটির উদ্যোগে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হতো। পাশাপাশি রুশ কালচারাল সেন্টার, ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনার, ব্রিটিশ কাউন্সিল, আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ ও আমেরিকান কালচারাল সেন্টারে নিয়মিত চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী হতো। চলচ্চিত্র সংসদের সদস্যরা সেসব আসরে আমন্ত্রিত হতেন। ১৯৭৫ সালের পর এই সংগঠনের কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে পড়ে। পরে ১৯৮১ সালের অক্টোবরে শিল্পী মুর্তজা বশিরকে সভাপতি ও আনোয়ার হোসেন পিন্টুকে সাধারণ সম্পাদক করে এই সংগঠন আবার সক্রিয় হয়। সঙ্গে যুক্ত হন আবুল মনসুর, শাহাদুজ্জামান, সাখাওয়াত আলী খান, শিল্পী ফয়জুল আজিম জ্যাকবসহ শিল্পসাহিত্য অঙ্গনের অনেকে। তাঁদের হাতেই প্রকাশিত হয় শিল্পসাহিত্যবিষয়ক পত্রিকা। অধ্যাপক আবুল মনসুরের সম্পাদনায় এই পত্রিকায় চলচ্চিত্র নিয়ে থাকত বিশেষ আয়োজন। এর পাশাপাশি সেই সময় আনোয়ার হোসেন পিন্টুর সম্পাদনায় ইন্টারকাট নামের বিশুদ্ধ চলচ্চিত্রবিষয়ক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এরপর আনোয়ার হোসেন পিন্টু, শৈবাল চৌধুরী এবং শাহাদুজ্জামানের যৌথ সম্পাদনায় বের হয় লুক থ্রু নামের আরও একটি চলচ্চিত্রবিষয়ক পত্রিকা। শৈবাল চৌধুরীর মতে, এমন ধারাবাহিক সাংগঠনিক তৎপরতার কারণে চট্টগ্রামে চলচ্চিত্রপ্রেমী দর্শক তৈরি হচ্ছিল। ১৯৯২ সালে চলচ্চিত্র সংসদের কার্যক্রমে ভাটা পড়ে। এর পরের বছর ১৯৯৩ সালের ১ জানুয়ারি গঠিত হয় নতুন সংগঠন চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্র। ৩৪ নন্দনকানন বৌদ্ধমন্দির সড়কের চতুর্থ তলায় স্থায়ী কার্যালয়ে সংগঠনের কার্যক্রম শুরু হয়।

শৈবাল চৌধুরী পরিচালক ও নাজিমুদ্দিন শ্যামল নতুন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নেন। গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন মিজানুর রহমান, হাসান ইমাম, গোলাম হায়দার কিসলু, সাজ্জাদ হোসেন উপল।

চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর জন্য শুরুতেই চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্র ১৬ মিলিমিটারের প্রজেক্টর সংগ্রহ করে। গড়ে তোলে চলচ্চিত্র আর্কাইভ ও গ্রন্থাগার। বর্তমানে সংগঠনের মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরসহ চলচ্চিত্র প্রদর্শনের সব সরঞ্জাম রয়েছে। আর আর্কাইভে আছে দুই হাজারের ওপর চলচ্চিত্র। আর্কাইভটির নাম রাখা হয় চলচ্চিত্র নির্মাতা জহির রায়হানের নামে। সংগঠনেরই প্রয়াত সদস্য সাজ্জাদ হাসান উপলের স্মরণে গ্রন্থাগারের নাম রাখা হয়েছে, সাজ্জাদ হাসান উপল স্মৃতি গ্রন্থাগার।

পথচলার শুরুর পর গত ২৬ বছরে পাঁচবার আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের আসরের আয়োজন করেছে চলচ্চিত্র কেন্দ্র। কোনো কোনো বার আসরে ৪০টির বেশি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়েছে। এসব আসরে চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর পাশাপাশি চলচ্চিত্র নিয়ে দেশি-বিদেশি নির্মাতাদের নিয়ে কর্মশালা, সেমিনার ও মুক্ত আলোচনাও ছিল।

এ ছাড়া সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, ইংমার বার্গম্যান, লুই বুনুয়েল, জাঁ লুক গদার, আকিরা কুরাসাওয়া, আব্বাস কিয়ারুস্তমি, মোহসেন মাকমালবাফ, আদুর গোপালকৃষ্ণান, জহির রায়হান, আলমগীর কবির, মোরশেদুল ইসলাম, ঋতুপর্ণ ঘোষ ও অপর্ণা সেনকে নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে বিশেষ চলচ্চিত্র আসর।

কেবল চলচ্চিত্র প্রদর্শনী নয়, চলচ্চিত্র নির্মাণেও এগিয়ে এসেছে এই সংগঠন। ১৯৯৬ সালে চলচ্চিত্র কেন্দ্রের সদস্য সাজ্জাদ হোসেন উপল নির্মাণ করেন প্রামাণ্য চলচ্চিত্র শাটল ট্রেন। এরপর শৈবাল চৌধুরীর পরিচালনায় আলোর মুখ দেখেছে আরও পাঁচটি চলচ্চিত্র। ১৯৯৯ সালে কবিয়াল ফনিবড়ুয়াকে নিয়ে দীপ্ত পদাবলী, ২০০০ সালে বিনয়বাঁশী জলদাসকে নিয়ে বিনয়বাঁশী, ২০০৬ সালে সাহিত্যিক মুশতারী শফীকে নিয়ে বিস্মৃত অধ্যায়, ২০১০ সালে মরমি গীতিকার ও সুরকার আব্দুর গফুর হালীকে নিয়ে, মেঠোপথের গান নির্মাণ করেন তিনি। ২০১৮ সালে মুক্তি পায় শৈবাল চৌধুরীর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্র ভূমিকম্পের পর

চট্টগ্রামের তুলসীধামের বিপরীতে অবস্থিত চারতলা ভবনের চতুর্থ তলায় চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্রের কার্যালয়। সংগঠনের সদস্যরা সংক্ষেপে ডাকেন সিএফসি (চিটাগাং ফিল্ম সেন্টার)। প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে সিএফসি কার্যালয়। ধূমায়িত গরম চায়ের সঙ্গে জমে ওঠে চলচ্চিত্র নিয়ে আড্ডা। কখনো ঋত্বিক, সত্যজিৎ, আবার কখনো তারকোভস্কি, বার্গম্যানের তুলনা চলে আসে সামনে। চলচ্চিত্রে বিষয়ের যে শেষ নেই। তাই প্রতিদিনই নতুন নতুন চিন্তার ঝড় ওঠে সংগঠনের কার্যালয়ে। বিগত ২৬ বছর চলচ্চিত্রের সঙ্গে আছেন এই সংগঠনের সদস্যরা।