স্টিকারের আড়ালে সড়কে চাঁদাবাজির অভিযোগ

ইজিবাইকসহ তিন চাকার যানবাহনের সামনের কাচে সাঁটানো থাকে স্টিকার। মাস পরিবর্তনের সঙ্গে বদলে যায় এগুলো। টাকার বিনিময়ে এসব স্টিকার সংগ্রহ করতে হয় যানবাহনের চালকদের।

এভাবে চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে যশোরের অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়া হাইওয়ে থানা-পুলিশের বিরুদ্ধে। পুলিশের নির্ধারিত লোকের কাছ থেকে মাসে ৫০০ টাকা করে ইজিবাইক (ব্যাটারিচালিত তিন চাকার যান) এবং ১ হাজার ৫০০ টাকা করে মাহিন্দ্রের (ডিজেল-চালিত তিন চাকার যান) চালকেরা স্টিকার কেনেন। যেসব ইজিবাইক ও মাহিন্দ্রের কাচে স্টিকার লাগানো নেই, সেসব ইজিবাইক ও মাহিন্দ্র থানায় নেওয়া হয়। পরে চালকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সেসব যানবাহন ছেড়ে দেওয়া হয়।

অভয়নগর উপজেলা সদর নওয়াপাড়ার ওপর দিয়ে চলে গেছে যশোর-খুলনা মহাসড়ক। খুলনার ফুলতলা উপজেলা থেকে নওয়াপাড়া পর্যন্ত এবং নওয়াপাড়া থেকে যশোর সদর উপজেলার বসুন্দিয়া পর্যন্ত মহাসড়কে আলাদাভাবে মাহিন্দ্র চলাচল করে। অভয়নগর উপজেলার রাজঘাট থেকে সদর উপজেলার বসুন্দিয়া পর্যন্ত মহাসড়কে ইজিবাইক চলাচল করে। এ ছাড়া নওয়াপাড়া থেকে আরও চারটি সড়কে ইজিবাইক, মাহিন্দ্র, ব্যাটারিচালিত ভ্যান, ইঞ্জিনচালিত ভটভটি এবং টেকার (জিপের মতো গাড়ি) চলাচল করে। এগুলোর মধ্যে পাঁচ শতাধিক ইজিবাইক, দেড় শতাধিক মাহিন্দ্র, দুই শতাধিক ব্যাটারিচালিত ভ্যান, ইঞ্জিনচালিত ভটভটি ও টেকার চলাচল করে।

নওয়াপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, যশোর-খুলনা মহাসড়ক দিয়ে চলছে ইজিবাইক, মাহিন্দ্র, ব্যাটারিচালিত ভ্যান ও ইঞ্জিনচালিত ভটভটি। উপজেলার রাজঘাট থেকে নওয়াপাড়া পর্যন্ত চলাচলকারী বেশির ভাগ ইজিবাইকের কাচে সাঁটানো রয়েছে কদম ফুলের স্টিকার। ওপরের দিকে লেখা রয়েছে, রাজঘাট-নওয়াপাড়া ইজিবাইক ড্রাইভার সমিতি। নওয়াপাড়া থেকে বসুন্দিয়া পর্যন্ত চলাচলকারী ইজিবাইকের কাচে সাঁটানো রয়েছে মাল্টার স্টিকার। খুলনার ফুলতলা উপজেলা থেকে নওয়াপাড়া এবং নওয়াপাড়া থেকে যশোর সদর উপজেলার বসুন্দিয়া পর্যন্ত চলাচলকারী মাহিন্দ্রের কাচে সাঁটানো রয়েছে হলুদ রঙের ওপর লাল কালি দিয়ে লেখা ড্রাইভার সমিতি। স্টিকারের ওপরের দিকে সবুজ কালি দিয়ে লেখা। নওয়াপাড়া-সুন্দলী, নওয়াপাড়া-আন্ধা, নওয়াপাড়া-পায়রা এবং নওয়াপাড়া-চুকনগর সড়কেও চলছে ইজিবাইক, মাহিন্দ্র, ব্যাটারিচালিত ভ্যান, ইঞ্জিনচালিত ভটভটি ও টেকার। তবে এসব যানবাহনে কোনো স্টিকার নেই।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ইজিবাইক ও মাহিন্দ্রচালক জানান, গত ২৩ জুলাই নওয়াপাড়া হাইওয়ে থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন নজরুল ইসলাম। এরপর তিনি নির্ধারিত লোক দিয়ে বিভিন্ন রকম স্টিকার ছাপান। এসব স্টিকারের মধ্যে রয়েছে ছাতা, হাঁস, প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল, মাল্টা ও কদম ফুল এবং ‘ড্রাইভার সমিতি’। ওই স্টিকার কিনতে তিনি প্রতি মাসে ইজিবাইকপ্রতি ৩০০ টাকা এবং মাহিন্দ্রপ্রতি ১ হাজার ২০০ টাকা নির্ধারণ করেন। গত অক্টোবর থেকে চাঁদা বাড়িয়ে ইজিবাইক ৫০০ টাকা এবং মাহিন্দ্রপ্রতি ১ হাজার ৫০০ টাকা করা হয়। বর্তমানে মাসে প্রায় ৫ লাখ টাকা চাঁদা উঠছে।

চালকেরা জানান, রাজঘাট ও নওয়াপাড়ার মধ্যে চলাচলকারী ইজিবাইকের চাঁদা তোলেন কামরুল ইসলাম ও রবিউল ইসলাম এবং নওয়াপাড়া-বসুন্দিয়া অংশে আবদুল হান্নান। খুলনার ফুলতলা উপজেলা থেকে নওয়াপাড়ায় চলাচলকারী মাহিন্দ্র থেকে চাঁদা তোলেন জাহিদুল ইসলাম, আবদুল আলিম ও আবদুস সালাম এবং নওয়াপাড়া থেকে বসুন্দিয়া পর্যন্ত চলাচলকারী মাহিন্দ্র থেকে চাঁদা তোলেন রাসেল আহমেদ। অপর চারটি সড়কে আলাদা লোক নির্ধারণ করা আছে। তাঁরাই মাসের ১ থেকে ১৫ তারিখের মধ্যে স্টিকার দিয়ে চাঁদা তোলেন।

ইজিবাইকচালক আবদুল হালিম বলেন, ‘আগে ঘাটে জাহাজ থেকে গমের বস্তা নামানোর কাজ করতাম। কোমরে ব্যথা পাওয়ায় এখন কাজ করতে পারি না। ধারকর্জ করে তিন মাস আগে একটি পুরোনো ইজিবাইক কিনেছি। টাকা এখনো শোধ হয়নি। কিন্তু প্রতি মাসে আমাকে পুলিশকে ৫০০ টাকা করে চাঁদা দিয়ে স্টিকার কিনতে হয়। চাঁদা দিতে না চাইলে নানাভাবে হয়রানি করে।’

মাহিন্দ্রচালক কেসমত আলী বলেন, ‘আমি ভাড়ার গাড়ি চালাই। দিনে ১ হাজার টাকার মতো আয় হয়। মালিককে ৫০০ টাকা এবং তেলের খরচ দিয়ে ২০০-২৫০ টাকার মতো থাকে। এরপর মাসে ১ হাজার ৫০০ টাকা চাঁদা দিয়ে ভীষণ সমস্যায় পড়তে হয়।’

চালকদের কাছ থেকে স্টিকার দিয়ে চাঁদা তোলেন রাজঘাট-নওয়াপাড়া ইজিবাইক সমিতির সভাপতি কামরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘হাইকোর্টের রায় রয়েছে মহাসড়কে কোনো ইজিবাইক চলবে না। কিন্তু আমরা তো চালাচ্ছি। এই কারণে প্রতি মাসে ৫০০ টাকা নিয়ে আমরা পুলিশকে দিচ্ছি। আমি ৮০টি ইজিবাইক থেকে টাকা তুলি।’

ফুলতলা-নওয়াপাড়া থ্রি-হুইলার ড্রাইভার সমিতির কোষাধ্যক্ষ আবদুল আলিম বলেন, ‘ফুলতলা থেকে নওয়াপাড়া পথে চলাচলকারী ৬৮টি মাহিন্দ্র রয়েছে। তবে প্রতিদিন গড়ে ৫৬টি গাড়ি চলাচল করে। প্রতিটি গাড়ি থেকে মাসে ১ হাজার ৫০০ টাকা করে নেওয়া হয়। কিছু গাড়ি ছাড়ও দেওয়া হয়। সব টাকা পুলিশকে দেওয়া হয় না। কিছু টাকা সেখান থেকে রেখে দেওয়া হয়। ওই টাকা দিয়ে হাইকোর্টে একটি রিট করা হবে।’

চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে নওয়াপাড়া হাইওয়ে থানায় ওসি নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কে চাঁদা নেয়, আমার জানা নেই। কোনো ব্যক্তি চাঁদাবাজি করে কি না, জানি না। যদি কেউ চাঁদা নেয়, তবে ড্রাইভাররা কেন চাঁদা দেবে? পুলিশের নাম দিয়ে কোনো শ্রমিক ইউনিয়ন যদি চাঁদাবাজি করে, তার দায়িত্ব পুলিশের নয়।’

হাইওয়ে পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মাদ ফরহাদ (যশোর সার্কেল) বলেন, ‘ওই যানবাহনগুলো হাইওয়েতে চলার প্রশ্নই ওঠে না। যদি চুক্তি করে এগুলো চলতে দেওয়া হয়, তাহলে তো সমস্যা। আমরা যদি তথ্য-প্রমাণ পাই, তাহলে অবশ্যই এ ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’