ওয়াসার ৪০ হাজার গ্রাহক ৩ ধাপে টাকা খরচ করেন

ঢাকা ওয়াসা
ঢাকা ওয়াসা

ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় ওয়াসার ৪০ হাজার গ্রাহককে পানির জন্য তিন ধাপে টাকা খরচ করতে হচ্ছে। ওয়াসার ৯৫টি পাম্প হাউসের পাশে তৈরি এটিএম বুথ থেকে গ্রাহকেরা টাকার বিনিময়ে বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ করছেন। সেই পানি রিকশায় বা ভ্যানে বাসায় নিতে হচ্ছে। আবার বাসায় থাকা ওয়াসার পানির লাইনের জন্য যথারীতি বিল দিতেই হয়।

চলতি বছরের মধ্যে এ ধরনের বুথের সংখ্যা ২০০ এবং গ্রাহকের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যাবে বলে দায়িত্বশীল সূত্র জানায়। উল্লেখ্য, ঢাকায় ওয়াসার পানির গ্রাহক রয়েছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ।

 ঢাকা ওয়াসার দায়িত্ব নগরবাসীকে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা। কিন্তু বিভিন্ন পাম্পে এ ধরনের এটিএম বুথ তৈরি করে আলাদাভাবে বিশুদ্ধ পানি বিক্রি করার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, ওয়াসার নিয়মিত গ্রাহকেরাই এই পানি সংগ্রহ করছেন।

রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অতি পুরোনো পাইপলাইনে মরিচা ধরে ছিদ্র তৈরি হয়েছে। অবৈধ সংযোগ নেওয়ার কারণে অনেক জায়গার পাইপ ফুটো হয়ে আছে। সেই পথে ময়লা ঢুকে পানি দূষিত হয় এবং বিভিন্ন বাড়িতে তা সরবরাহ হয়। এই পরিস্থিতিতে গ্রাহকদের অনেকেই ওয়াসার পাম্প হাউসের কল থেকে সরাসরি পানি সংগ্রহ করে আসছিলেন। কিন্তু ৯৫টি পাম্পে এটিএম বুথ বসানোর কারণে সেসব পানির কল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সবাই এখন টাকা দিয়ে বুথ থেকে পানি কিনছেন।

>

ওয়াসাকে মাসিক বিল দিতে হয়, বুথ থেকে পানি কিনতে হয় এবং রিকশা বা ভ্যানে করে সেই পানি বাসায় নিতে হয়।

 ‘ড্রিংক ওয়েল’ নামে একটি কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে ওয়াসা বুথগুলো বসিয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী আগামী বছরের মধ্যে মোট ৩০০টি পাম্প হাউসে এ ধরনের বুথ বসবে। ২০১৭ সালের জুলাই থেকে মুগদা, বাসাবোসহ বিভিন্ন স্থানে এই বুথ বসানো হয়। আর পরীক্ষামূলক (পাইলট) প্রকল্প হিসেবে ওয়াসা ২০১৬ সালে ফকিরাপুলে অবস্থিত অঞ্চল-৬ কার্যালয় এলাকায় এ ধরনের বুথ তৈরি করে। সব বুথেই বিশুদ্ধকরণ যন্ত্রের সাহায্যে গভীর নলকূপের পানি শোধন করে বিক্রি করা হচ্ছে। এ জন্য গ্রাহকদের নির্দিষ্ট পরিমাণ জামানত দিয়ে নিবন্ধন নিতে হয়। এরপর এটিএম ব্যবহারকারীকে দেওয়া হয় প্রিপেইড স্মার্ট কার্ড। ওই কার্ডে টাকা ঢুকিয়ে (রিচার্জ) পানি কেনা যায়। প্রতি লিটারের দাম ৪০ পয়সা।

ওয়াসা সূত্র জানায়, ওয়াসার নিয়মিত বিলের বাইরে ৯৫টি বুথ থেকে গত অক্টোবর মাসে ৩৭ লাখ লিটার পানি বিক্রি করা হয়েছে। বাসাবাড়িতে ওয়াসার পানি সরবরাহের জন্য গ্রাহকপ্রতি মাসে গড়ে ৫০০ টাকা করে বিল হয়। কোনো গ্রাহক সরাসরি, কেউবা বাড়িওয়ালার মাধ্যমে বিল পরিশোধ করেন। ৪০ হাজার গ্রাহককে মাসিক বিল হিসেবে গড়ে ৫০০ টাকা করে মোট দুই কোটি টাকা দিতে হচ্ছে। এই টাকা দেওয়ার পরও বুথ থেকে পানি কিনতে গ্রাহকদের আলাদা টাকা দিতে হচ্ছে। আর বুথ থেকে পানি আনার জন্য রিকশা বা ভ্যান ভাড়া বাবদ খরচ করতে হয়েছে আরও কিছু টাকা।

পুরান ঢাকার বালুর মাঠে অবস্থিত গোপীবাগ পানির পাম্পের বিশুদ্ধ পানি বিক্রির কেন্দ্র বা বুথ খোলা হয়েছে গত মে মাসে। গত সপ্তাহে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, পাম্পের পাশেই স্থাপিত খাবার পানির বিক্রয়কেন্দ্র বা এটিএম বুথ থেকে ওয়াসার অনেক গ্রাহক বড় বড় জারে পানি কিনছেন। গ্রাহকেরা জানান, এলাকায় ওয়াসার সরবরাহ করা পানিতে দুর্গন্ধ থাকায় বাড়তি টাকা খরচ করে তাঁদের খাবার পানি কিনতে হচ্ছে। এই বুথে বর্তমানে আড়াই হাজার গ্রাহক রয়েছেন।

ড্রিংক ওয়েলের এই বুথের ব্যবস্থাপক সজল মণ্ডল জানান, বুথ থেকে প্রতিদিন গড়ে দশ হাজার লিটার পানি বিক্রি হচ্ছে। গ্রাহকসংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। প্রতিদিন সকাল ছয়টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত বুথ খোলা থাকে।

গোপীবাগ ছাড়াও রামকৃষ্ণ মিশন রোড, পেয়াদাপাড়া, অভয় দাস লেন, দক্ষিণ কমলাপুরের বাসিন্দারাও এখানে আসছেন পানি নিতে।

পেয়াদাপাড়ার গ্রাহক মকবুল আহমেদ বলেন, আগে তাঁর বাসায় পানির বিল দিতে হতো ৫০০ টাকা। চলতি মাস থেকে ৬০০ টাকা দিতে হচ্ছে। পানিতে গন্ধ। পান করা দূরে থাক, গোসল পর্যন্ত করতে খারাপ লাগে।

বাসাবোর কদমতলী পানির পাম্পে গিয়ে দেখা যায়, চারপাশের এলাকাবাসী পানি সংগ্রহে ব্যস্ত। অন্তত ৫০ জন লোক পানির জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছেন। এলাকায় বিশুদ্ধ পানির সংকট সারা বছরই। আহম্মদবাগ এলাকার গ্রাহক আবদুর রহমান তাঁর বাসার কলে আসা পানিতে গন্ধের বর্ণনা দিয়ে বলেন, বাধ্য হয়ে পাম্প থেকে পানি নিয়ে যান। কার্ড ব্যবহার করে পানি কেনেন, তবু সান্ত্বনা বিশুদ্ধ পানি পাচ্ছেন।

এই পাম্পে প্রতিদিন প্রায় ২৮ হাজার লিটার পানি শোধন করে বিক্রি হয়। দেখা যায়, পানি কেনার পর বিভিন্ন বহুতল ভবনের বাসিন্দারা একযোগে ভ্যান ভাড়া করে পানি নিয়ে যাচ্ছেন। সকালে ও সন্ধ্যায় ভিড় বেশি হয় বলে জানান ওই অপারেটর।

মুগদা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ওয়াসার ২ নম্বর পানির পাম্পে বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহে মানুষের ভিড়। দক্ষিণ মুগদার বাসিন্দা শামসুল আলম বলেন, বিশুদ্ধ পানির নিশ্চয়তা থাকায় আলাদা খরচ করে বাসায় পানি নিয়ে যান। ওয়াসা গলির বাসিন্দা দিব্যেন্দু পালিত পাঁচটি বড় জারে করে পানি নিচ্ছেন। তিনি বলেন, এখান থেকে পানি নিলে ফুটাতে হয় না—এটাই স্বস্তি।

 একই গ্রাহকের তিন ধাপে পানির জন্য টাকা খরচ করার বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা মন্তব্য করতে চাননি। ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান দেশের বাইরে আছেন। তবে একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ওয়াসার সব পুরোনো পাইপ পরিবর্তন করা হলে বুথের প্রয়োজনীয়তা কমে যাবে। কারণ, তখন বাসার কলেও ভালো পানি আসবে। তবে গ্রাহকের নিজস্ব ট্যাংক পরিষ্কার রাখতে হবে।

ঢাকা ওয়াসার অঞ্চল-৬-এ সবচেয়ে বেশি পাম্পে এটিএম বুথ রয়েছে। নির্বাহী পরিচালক ইয়ার খান প্রথম আলোকে বলেন, শুধু গ্রাহক নয়, যাঁদের বৈধ সংযোগ নেই, এমনকি পথচারীও এই সেবা নিতে পারেন।

ড্রিংক ওয়েলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইমতিয়াজ চৌধুরী বলেন, প্রথমে চিন্তা করা হয়েছিল যাঁরা ওয়াসার গ্রাহক নন, তাঁদের এই সেবা দেওয়া হবে। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। পদ্মার পানি শোধনাগারের মতো নির্মাণাধীন অন্য শোধনাগারগুলো চালু হলে গভীর নলকূপের পাম্পসংখ্যা কমে যাবে। তখন অনেক পাম্প বন্ধ রাখা হবে।

উল্লেখ্য, এখন বাসাবোসহ ওয়াসার অঞ্চল–১-এ ২০টি, নাজিরাবাজারসহ অঞ্চল–২-এ ৬টি, কলাবাগানসহ অঞ্চল–৩-এ ৭টি, সূত্রাপুরসহ অঞ্চল-৪–এ ৫টি, গুলশানসহ অঞ্চল–৫-এ ৫টি, সিদ্ধেশ্বরী, গোরান, বনশ্রীসহ অঞ্চল-৬-এ ২৫টি, রায়েরবাগে অঞ্চল ৭-এ ১টি, শাহজাদপুরসহ অঞ্চল-৮–এ সাতটি, খিলক্ষেতসহ অঞ্চল–৯–এ ১০টি, মিরপুরসহ অঞ্চল ১০-এ ৯টি এটিএম বুথ বসানো হয়েছে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবীর ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, এভাবে ভোক্তাদের ওপর বাড়তি চাপ ও খরচ মেনে নেওয়া যায় না। এটা অনৈতিক ও অন্যায়। তাঁর মতে, বিশুদ্ধ পানি দেওয়া ওয়াসার দায়িত্ব এবং এ জন্যই সংস্থাটি গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নেয়।