পটিয়া স্বাস্থ্যকেন্দ্র: সংকটেও প্রসূতিসেবায় ভরসা

পরম স্নেহে সদ্যোজাত কন্যাসন্তানকে বুকে আগলে রেখেছেন গৃহবধূ বাবুটি দাশ। কোনো ভোগান্তি ছাড়াই সুস্থভাবে সন্তান প্রসব হওয়ায় তিনি বেশ খুশি। মুখে হাসি ফুটেছে স্বামী দোকান কর্মচারী রূপক দাশেরও। নবজাতক আর স্ত্রীকে নিয়ে উপজেলার কচুয়াই এলাকায় অবস্থিত ঘরে ফেরার অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। 

গত সোমবার দুপুর ১২টায় চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রসূতি ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা মেলে তাঁদের। সোমবার সকাল ৮টায় বাবুটি দাশকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর দুই ঘণ্টার মাথায় এ দম্পতির কোলজুড়ে আসে নবজাতক। মা ও নবজাতক দুজনই সুস্থ আছে। 

একই সময়ে ওয়ার্ডে প্রসবসেবা নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন উপজেলার কেলিশহর ইউনিয়নের মণি সর্দার ও হাইদগাঁও ইউনিয়নের মণি নাথ নামের আরও দুই নারী। 

পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এমন দৃশ্যের দেখা মেলে প্রতিদিনই। বিশেষ করে দরিদ্র ও অসহায় নারীদের প্রসবকালীন সেবার জন্য এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। স্বাভাবিক প্রসবের পাশাপাশি অস্ত্রোপচার করে প্রসব করানোর ব্যবস্থা আছে। 

এ ছাড়া উন্নত বিশ্বের ন্যায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মিডওয়াইফ দ্বারা ২৪ ঘণ্টা স্বাভাবিক প্রসব সেবাও দেওয়া হয় এখানে। অস্ত্রোপচারের জন্য আছেন একজন করে প্রসূতি বিশেষজ্ঞ ও অবচেতনবিদ (ডি. এ. ডিগ্রিধারী মেডিকেল অফিসার)। 

একদিকে ভালো সেবার নিশ্চয়তা অন্যদিকে যাতায়াতব্যবস্থা ভালো থাকায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পাশের এ হাসপাতালে পটিয়া উপজেলা ছাড়াও পার্শ্ববর্তী চন্দনাইশ, বোয়ালখালী ও আনোয়ারা উপজেলা থেকেও প্রসবসেবা গ্রহীতারা ছুটে আসেন। অথচ হাসপাতালে রয়েছে জনবলসহ নানা সংকট।

সেবা নেওয়ার চিত্র
হাসপাতালে ২০১৮ সালের শুরু থেকে এ পর্যন্ত সেবা নেওয়া রোগীর হিসাব পাওয়া গেছে। এই সময়ে কোনো মাতৃমৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। চলতি বছরে এ পর্যন্ত সেবা নিয়েছেন ৩ হাজার ৭৯৪ প্রসূতি। আর প্রসবের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৯৪৭ জন। তাঁদের মধ্যে স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে ৬৫৯ জনের, অস্ত্রোপচার হয়েছে ৪৭ জনের। অবস্থা জটিল হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য স্থানান্তর করা হয়েছে ২৪১ নারীকে। অন্যদিকে ২০১৮ সালে সেবা নিয়েছেন ৪ হাজার ৭৯৫ জন নারী। প্রসবের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ১৫ জন। এঁদের মধ্যে স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে ৭০৫ জনের। অস্ত্রোপচার হয়েছে আরও ৬৫ জনের। অবস্থা জটিল হওয়ার কারণে ২৪৫ জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য স্থানান্তর করা হয়েছে। কোনো মাতৃমৃত্যু ছিল না। 

হাসপাতালের সেবা সম্পর্কে জানতে চাইলে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বাবুটি দাশের স্বামী রূপক দাশ বলেন, ‘আমরা দরিদ্র মানুষ। সামান্য বেতনের চাকরি করি। তাই আমাদের পক্ষে বেসরকারি হাসপাতালে যাওয়া সম্ভব নয়। এখানে আসার পর চিকিৎসক ও নার্সরা আন্তরিকতার সঙ্গে সেবা দিয়েছেন। কোনো ভোগান্তি হয়নি। টাকাপয়সাও তেমন খরচ হয়নি।’

সমস্যা মিটলে ২৪ ঘণ্টা সেবা
রোগীদের ভালো সেবা দিয়ে এলেও নানা সমস্যায় ধুঁকছে হাসপাতালটি। দীর্ঘদিন ধরে জনবলসংকটের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ মেশিন নষ্ট থাকায় ২৪ ঘণ্টা সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। 

উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা একরামুল আজম বলেন, ‘বেসরকারি হাসপাতালে একজন মায়ের অস্ত্রোপচারে ১৬ থেকে ৩০ হাজার এবং স্বাভাবিক প্রসবে ৩ থেকে ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ পড়ে। আমরা বিনা খরচেই সর্বাধুনিক প্রসব সেবা দিয়ে আসছি।’ 

জনবলসংকটের কথা বলতে গিয়ে একরামুল আজম বলেন, নিয়মিত অবেদনবিদ না থাকায় একজন চিকিৎসা কর্মকর্তাকে (অবেদনবিদ বিষয়ে ডি. এ. ডিগ্রিধারী) রোগী দেখার পাশাপাশি প্রসূতি বিভাগে অবেদনবিদের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। ডায়াথারামি মেশিনটিও (রক্তনালি বন্ধকরণ মেশিন) ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নষ্ট। এতে অস্ত্রোপচারের সময় অন্য উপায়ে রক্ত বন্ধের কাজ চালিয়ে নিতে হচ্ছে। এসব সমস্যা কাটানো গেলে ২৪ ঘণ্টা উন্নত এবং ভালো সেবা দেওয়া সম্ভব হবে। 

একই কথা বলেন হাসপাতালের প্রসূতি বিশেষজ্ঞ ফারহানা নুরও।