যে কারণে সাত জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড, একজন পেলেন খালাস

গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার মামলায় গ্রেপ্তার নব্য জেএমবির সাত সদস্যের মৃত্যুদণ্ড এবং এক আসামির খালাসের কারণ আদালতের রায়ে বিস্তারিত উঠে এসেছে। আজ বুধবার ঢাকার সন্ত্রাস বিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মুজিবর রহমান এই রায় ঘোষণা করেন।

রায়ে আদালত বলেছেন, তামিম চৌধুরী, নুরুল ইসলাম মারজান আর সরোয়ার জাহান হামলার মূল পরিকল্পনায় ছিল। এই তিনজনের পরিকল্পনায় জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে, রাকিবুল হাসান প্রশিক্ষণ ও প্ররোচনা দিয়ে, আবদুস সবুর পরিকল্পনা ও অনুমোদন দিয়ে গুলশানের হোলি আর্টিজানে হামলায় জড়িত ছিলেন। এ ছাড়া আসলাম হোসেন অস্ত্র ও গুলি আনা নেওয়া করেন, হাদিসুর রহমান সাগর অস্ত্র সংগ্রহ করেন, মামুনুর রশীদ অস্ত্র সরবরাহ করেন আর শরিফুল ইসলাম খালেদ হামলার পরিকল্পনা করেন।

মিজানুর রহমানের খালাসের ব্যাপারে আদালত রায়ে বলেছেন, কোনো আসামি তাদের জবানবন্দিতে উল্লেখ করেননি, মিজানুর গুলশানের হোলি আর্টিজান হামলার বিষয়ে জানত বা কোনো ভাবে জড়িত ছিল।

জাহাঙ্গীর আলম
জাহাঙ্গীর আলম

যে কারণে রাজীব গান্ধীর মৃত্যুদণ্ড:

জঙ্গি নেতা তামীম যে হামলার প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করবেন তা আরেক জঙ্গি জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধীর জবানবন্দিতে উঠে এসেছে। গাইবান্ধায় জঙ্গি তামিম, মেজর জাহিদ, সরোয়ার, তারেক, মারজান, শরিফুল ও জাহাঙ্গীর মিটিং করেন ২০১৬ সালে। তামিমের পরিকল্পনায় গাইবান্ধায় তারেক জঙ্গিদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিত। মেজর জাহিদ অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দিত। প্রশিক্ষণ শেষে ছয় জঙ্গিকে বসুন্ধরায় আরেক জঙ্গি তানভীরের বাসায় নিয়ে আসা হয়। বসুন্ধরার ওই বাসার একটি কক্ষে থাকত, রোহান, শফিকুল, নিবরাস, মোবাশ্বের, শরিফুল ও খাইরুল। আরেকটি কক্ষে ছিল তামিম, মারজান, বাশারুজ্জামান ও সরোয়ার। ওই বাসায় তানভীর কাদেরী তার পরিবার নিয়ে থাকত। তামিমের কথামত জাহাঙ্গীর ২০১৬ সালের ২৭ জুন হোলি আর্টিজান বেকারিতে যায়। তার সঙ্গে ছিল সেদিন মারজান, রোহান ও নিবরাস। পরের দিন হোলি আর্টিজান বেকারিতে যায় বাশারুজ্জামান, শফিকুল আর খাইরুল। এর দুই দিন পর আবার তারা হোলি আর্টিজান বেকারি রেকি করে আসে। হামলা করার জন্য যে ছয়জন জঙ্গি প্রশিক্ষণ নেয়, তাদের মধ্যে শরিফুল কিশোরগঞ্জে হামলা চালাতে গিয়ে মারা যায়। হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার প্রধান দায়িত্ব পায় রোহান। হামলা করার এক মাস আগে তিন থেকে চারটি একে-২২ রাইফেল জঙ্গি মামুনুরের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়। আর মারজান হাদিসুরের মাধ্যমে অস্ত্র ও বিস্ফোরক আমের ঝুড়িতে করে বসুন্ধরায় জঙ্গিদের বাসায় নিয়ে আসা হয়। হাতকাটা মাহফুজ শেওড়াপাড়ায় জঙ্গি বাসারুজ্জামানের বাসায় গ্রেনেড বানায়।

মামলার সাক্ষী জঙ্গি তানভীর কাদেরীর ছেলে আদালতে সাক্ষ্য দেন। তাকে আদালত গুলশানের হোলি আর্টিজান হামলা মামলার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। রায়ে আদালত বলেছেন, তানভীরের ছেলে আদালতে বলেছে, জাহাঙ্গীরকে সপরিবারে তারা বসুন্ধরার বাসায় দেখেছে।
রায়ে আদালত আরও বলেছেন, জাহাঙ্গীরের জবানবন্দি এবং সাক্ষীদের সাক্ষ্য বিশ্লেষণে পাওয়া যায়, জাহাঙ্গীর গুলশানের হোলি আর্টিজান হামলার পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ করে। প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সংগ্রহ থেকে শুরু করে সর্ব পরি তামিমের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে হামলাকারীদের সঙ্গে অবস্থান করে।

আসলাম
আসলাম

তামিমের সঙ্গে পরিকল্পনায় ছিলেন আসলামও:
জঙ্গি আসলাম কীভাবে গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারির হামলায় জড়িত, সে ব্যাপারে আদালত রায়ে বলেছেন, হোলি আর্টিজান হামলার আগে সে সেখানে রেকি করে। গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী তানভীরের ছেলে আদালতে তার সাক্ষ্যে বলেছে, আসলাম তাদের পল্লবীর বাসায় যেত। আসলামই তার বাবাকে বসুন্ধরায় বাসা নেওয়ার জন্য বলে। বসুন্ধরার বাসা আসলামই দেখেছিল। রায়ে আদালত বলেছেন, তানভীরের ছেলে সেদিন আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসলামকে শনাক্ত করে। আসলামও তামিমের সঙ্গে থেকে গুলশানের হোলি আর্টিজান হামলার পরিকল্পনায় অংশ নেয়।

সবুর খান
সবুর খান

বোমা তৈরি করেন সবুর:
আব্দস সবুর খানের ব্যাপারে আদালত তার রায়ে বলেছেন, সবুরের তৈরি বোমা গুলশানের হোলি আর্টিজান হামলায় হামলাকারীরা ব্যবহার করেছিল।

হাদিসুর রহমান
হাদিসুর রহমান

যশোর থেকে অস্ত্র-গুলি আনেন হাদিসুর:
হাদিসুর রহমান সাগর কীভাবে জড়িত সে ব্যাপারে আদালত রায়ে বলেছেন, গুলশানের হোলি আর্টিজান হামলার ২০ থেকে ২২ দিন আগে হাদিসুর অস্ত্র, গুলি আর গ্রেনেড যশোর থেকে হানিফ পরিবহনে করে ঢাকায় তামিমের কাছে পৌঁছে দেয়। যা গুলশানের হোলি আর্টিজান হামলায় ব্যবহার করা হয়।

মামুনুর রশীদ
মামুনুর রশীদ

মামুনুর সংগ্রহ করে একে-২২ রাইফেল:
মামুনুর রশীদ কীভাবে ভয়াবহ এই হামলায় জড়িত সে ব্যাপারে আদালত বলেছেন, ২০১৬ সালের জুন মাসে মামুনুরের মাধ্যমে তিন থেকে চারটি একে-২২ রাইফেল সংগ্রহ করা হয়। তিনজন সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দিয়ে যে অস্ত্র উদ্ধারের কথা বলেছে, তার সঙ্গে মামুনুরের আনা তিন থেকে চারটি রাইফেলের অভিযোগ সমর্থন করে।

শরিফুল ইসলাম
শরিফুল ইসলাম

হামলা সফল করার দায়িত্বে ছিলেন শরিফুল:
শরিফুল ইসলাম খালেদের ব্যাপারে রায়ে বলা হয়েছে, আসামি জাহাঙ্গীর, আসলাম, রাকিবুলের স্বীকারোক্তি পর্যালোচনায় দেখা যায়, খালেদ গুলশানের হোলি আর্টিজান হামলার পরিকল্পনাকারীদের একজন। তামিম, মারজান ও আসলামের সঙ্গে সে নিয়মিত যোগাযোগ রাখত। হামলা সফল করার ব্যবস্থা করে।

রাকিবুল হাসান
রাকিবুল হাসান

হামলাকারী ৫ জঙ্গিতে প্রশিক্ষণ দেন রাকিবুল:
রাকিবুল হাসান রিগান কীভাবে হামলায় জড়িত, সে ব্যাপারে আদালত রায়ে বলেছেন, রাকিবুল হাসান আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছেন, তামিম ও মারজানের কথামত বসুন্ধরার বাসায় হামলাকারী মোবাশ্বের, রোহান, নিবরাস, খাইরুল ও শফিকুলদের প্রশিক্ষণ দেয়। 

হামলাকারীদের সে বলেছিল, হামলা সফল করতে গিয়ে যদি মারাও যায় তাহলে তারা শহীদের মর্যাদা পাবে। গুলশানের হোলি আর্টিজানে হামলা করার পর তার বন্ধু রনির মোবাইলের অ্যাপসের মাধ্যমে ছবিও পাঠানো হয়।

মিজান
মিজান

এই মিজান যে বড় মিজান তা সাক্ষ্যে আসেনি :

রায়ে আদালত বলেছেন, মিজানুর রহমান আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছেন, তিনি মাছের ব্যবসা করতেন। ২০১৬ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে হারিস ওরফে করিম একদিন তাকে বলেছিল, তার সঙ্গে জামাল নামের একটা ছেলে দেখা করবে। জামাল সেদিন বিকেলে তার কাছে আসে। তার হাতে একটা ব্যাগ দেখেন। জামালের ব্যাগে যা ছিল তা জেল বোমা বলে শুনেছি। জামাল তাকে বলেছিল, এই জেল বোমা গুলশানে বড় ধরনের হামলায় ব্যবহৃত হবে।

আদালত রায়ে আরও বলেছেন, মামলার কোনো সাক্ষী হারিছ বা জামালের নাম কোথাও উল্লেখ করেননি। জাহাঙ্গীর জবানবন্দিতে বলা হয়, প্রশিক্ষণে ব্যবহার করা অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বোমা বানানোর সরঞ্জাম ছোট মিজান ভারতে অবস্থানরত বড় ভাই বড় মিজানের মাধ্যমে সংগ্রহ করে মারজানকে দেয়। আদালত জাহাঙ্গীরের জবানবন্দি তথ্য তুলে ধরে বলেছেন, জাহাঙ্গীরের জবানবন্দিতে উল্লেখ করা বড় মিজান যে এই মামলার আসামি মিজানুর রহমান তা সাক্ষ্যে আসেনি। অন্য কোনো আসামি তাদের জবানবন্দিতে উল্লেখ করেননি যে,এই মামলার আসামি মিজানুর গুলশানের হোলি আর্টিজান হামলার বিষয়ে জানত বা কোনো ভাবে জড়িত ছিল।