প্রতিবন্ধিতাই সিয়ামের শক্তি

দুই হাত নেই। পায়ের আঙুলে কলম চেপে পরীক্ষা দিচ্ছে সিয়াম। গতকাল সরিষাবাড়ীর চাপারকোনা মহেশ চন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ে।  ছবি: প্রথম আলো
দুই হাত নেই। পায়ের আঙুলে কলম চেপে পরীক্ষা দিচ্ছে সিয়াম। গতকাল সরিষাবাড়ীর চাপারকোনা মহেশ চন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ে। ছবি: প্রথম আলো

সবাই বসে বেঞ্চে। পরীক্ষা দেয় হাতে লিখে। আর সিয়াম বসে টেবিলে। পরীক্ষা দেয় পায়ে লিখে। অন্য সবার সঙ্গেই পরীক্ষা শেষ করে সে। বাড়তি সময়ের প্রয়োজন হয় না। শারীরিক প্রতিবন্ধিতাই যেন তার শক্তি।

গতকাল বৃহস্পতিবার চাপারকোনা মহেশ চন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ে গেলে এই দৃশ্য চোখে পড়ে। ষষ্ঠ শ্রেণির শারীরিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী সিয়াম মিয়া পা দিয়ে লিখেই এবার বার্ষিক পরীক্ষা দিচ্ছে।

জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলায় চাপারকোনা মহেশ চন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের অবস্থান।

সিয়াম ও তার পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলার ডোয়াইল ইউনিয়নের উদনাপাড়া গ্রামের দিনমজুর জিন্নাহ মিয়ার ছেলে সিয়াম (১১)। ২০০৮ সালে জোসনা বেগমের ঘর আলো করে জন্মগ্রহণ করে সে। দুই হাত ছাড়াই জন্ম হয় সিয়ামের। ২০১৪ সালে বাড়ির পাশের উদনাপাড়া ব্র্যাক স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে তাকে ভর্তি করিয়ে দেন মা-বাবা। ভর্তি হওয়ার পর থেকে সিয়াম বাম পা দিয়ে লিখে এগিয়ে যেতে থাকে।

চতুর্থ শ্রেণিতে ওঠার আগেই অভাবের তাড়নায় সিয়ামের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। বড় বোন জিমি খাতুন স্নাতকে পড়েন। মেজ ভাই এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে। অভাবের সংসারে দিনমজুর জিন্নাহ মিয়া তিন সন্তানের লেখাপড়ার খরচ চালাতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

সিয়াম বিদ্যালয়ে পড়তে না আসায় উদনাপাড়া ব্র্যাক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা জাকিয়া সুলতানা তাদের বাড়িতে খোঁজ নেন। তখন পরিবারের লোকজন বলেন, তাঁরা খাওয়ার খরচ দিতে পারেন না। কী করে সিয়ামকে স্কুলে পাঠাবেন। এ কথা শুনে জাকিয়া সুলতানা সিয়ামের লেখাপড়ার দায়িত্ব নেন। এক বছর পড়ালেখা বন্ধ থাকার পর ২০১৮ সালে আবার তাকে উদনাপাড়া ব্র্যাক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে দেন তিনি।

২০১৮ সালের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় সিয়াম ৪ দশমিক ৮৩ পেয়ে কৃতকার্য হয়। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে সিয়াম চাপারকোনা মহেশ চন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়। গতকাল সে বিদ্যালয়ের অন্য পরীক্ষার্থীদের মতো ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষা দেয়।

সিয়াম বলে, ‘পা দিয়ে লিখতে একটু কষ্ট হয়। কিছুক্ষণ পরপর পায়ে ব্যথা করে। একটু বসে থেকে আবার লেখা শুরু করি। ২ ঘণ্টা সময় দেওয়া থাকলেও আমি ১৫ মিনিট আগেই সব প্রশ্নের উত্তর লেখা শেষ করেছি। আমি কারও সহযোগিতা পেলে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চাই।’

সিয়ামের সহপাঠী পারভেজ জানায়, সিয়ামকে সব সময় তাদের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হয়। সিয়াম সবার আগেই পা দিয়ে লিখে পরীক্ষা শেষ করে।

সিয়ামের বাবা জিন্নাহ মিয়া বলেন, ‘অন্যের বাড়িতে কাজ করে তিন ছেলেমেয়েকে এ পর্যন্ত এনেছি। বাড়ির ভিটা ছাড়া আমার আর সহায়–সম্বল কিছুই নেই। ছেলে আমার প্রতিবন্ধী নয়। ভবিষ্যৎ সোনার টুকরা।’

সিয়ামের মা জোসনা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘অভাবের সংসারে প্রতিবন্ধী ছেলেরে পড়ালেখার খরচ দিতে না পারায় তার এক বছর লেখাপড়া বন্ধ ছিল। ছেলেরে ঠিকমতো খাবার দিতে পারি নাই। তবু ছেলে আমার রাগ না করে স্কুলে গেছে।’

বিদ্যালয়ের কক্ষ পরিদর্শক ও জ্যেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক আলতাফ হোসেন জানান, প্রতিবন্ধীদের অতিরিক্ত সময় না নিয়েই ১৫ মিনিট আগে সিয়াম পরীক্ষা শেষ করেছে।

চাপারকোনা মহেশ চন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম জানান, বিনা পয়সায় সিয়াম বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে। সে একদিন দেশের গৌরব বয়ে আনবে, পরীক্ষায় ভালো ফল করবে।

বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ফজলুল হক বলেন, ‘সিয়াম একজন মেধাবী শিক্ষার্থী। সে আমার বিদ্যালয়ের গর্ব। সিয়ামের পড়ালেখার জন্য সার্বিক সহযোগিতা করে যাব।’