প্রতি তিন ইটভাটার একটি অবৈধ

ভাটায় ইট পোড়ানো চলছে। নির্গত হচ্ছে কালো ধোঁয়া। দূষিত হচ্ছে বাতাস। গতকাল বিকেলে নারায়ণগঞ্জের বক্তাবলীর ফেরিঘাট এলাকায়।  ছবি: দিনার মাহমুদ
ভাটায় ইট পোড়ানো চলছে। নির্গত হচ্ছে কালো ধোঁয়া। দূষিত হচ্ছে বাতাস। গতকাল বিকেলে নারায়ণগঞ্জের বক্তাবলীর ফেরিঘাট এলাকায়। ছবি: দিনার মাহমুদ

দেশের ইটভাটাগুলোর তিনটির একটি অবৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এগুলোর পরিবেশগত ছাড়পত্র যেমন নেই, তেমনি পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিও গ্রহণ করেনি। সারা দেশে এমন ইটভাটা তিন হাজারের বেশি। পরিবেশ অধিদপ্তর গত বুধবার এসব অবৈধ ইটভাটার প্রাথমিক তালিকা করেছে।

এসব ইটভাটা মারাত্মক বায়ুদূষণের বড় উৎস। বৈশ্বিক বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান এয়ারভিজ্যুয়ালের তথ্যমতে, গতকাল বৃহস্পতিবার রাত পৌনে নয়টায় বিশ্বের ৯১টি বড় শহরের মধ্যে ঢাকার বায়ুমান ছিল দূষণের দিক থেকে দ্বিতীয়। চলতি মাসের প্রায় পুরো সময়েও ঢাকা বিশ্বের অন্যতম দূষিত বায়ুর শহর হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। দূষণের পরিস্থিতিতে গত সোমবার আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক করে বায়ুদূষণরোধে নানা পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এর পরদিন উচ্চ আদালত ঢাকা ও এর পাশের চারটি জেলায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অবৈধ ইটভাটাগুলো ১৫ দিনের মধ্যে বন্ধ করতে নির্দেশ দেন।

নিয়ম অনুযায়ী, সরকার ২০১৫ সালের পর পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি নেই, এমন ইটভাটাগুলো বন্ধ করে দেবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবে, বর্তমানে সারা দেশে ৮ হাজার ৩৩টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ৮৩৭টি পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি গ্রহণ করেনি। আর পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই ২ হাজার ৫১৩টির। এই দুটি শর্তই পালন করেনি এমন ইটভাটা রয়েছে তিন হাজারের বেশি। তিন
বছর ধরে এসব ইটভাটা মারাত্মক দূষণ করে চলেছে।

>

সবচেয়ে বেশি অবৈধ ইটভাটা ঢাকা বিভাগে। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি গ্রহণ করেনি সবচেয়ে বেশি চট্টগ্রাম বিভাগে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার অবৈধ ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছে। তবে শুষ্ক মৌসুমে আমাদের উন্নয়নকাজগুলো পুরোদমে চলে। এই সময়ে প্রচুর ইটের দরকার হয়। সব অবৈধ ইটভাটা একযোগে বন্ধ করে দিলে তা উন্নয়নে প্রভাব পড়বে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখতে হবে। তবে উন্নয়ন ও দূষণ নিয়ন্ত্রণকে সমন্বয় করে কাজ করবে সরকার।’

অবৈধ ইটভাটা সবচেয়ে বেশি ঢাকায়

পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশের সবচেয়ে বেশি অবৈধ ইটভাটা গড়ে উঠেছে ঢাকা বিভাগে। এই বিভাগে পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়াই চলছে ৬৮৮টি। এরপর বেশি অবৈধ ইটভাটা রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে—৫২৫টি। এককভাবে চট্টগ্রাম জেলায় ৪১৮টি ইটভাটার মধ্যে ১৪৬টির পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই। আর ২৭১টি ইটভাটা পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি গ্রহণ করেনি। এরপর খুলনায় ৩০০, রাজশাহীতে ৩০০ ও রংপুর বিভাগে ৩৭৪টি ইটভাটার পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই।

দেশের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-২০১০ ও ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৩ অনুযায়ী বসতি এলাকা, পাহাড়, বন ও জলাভূমির এক কিলোমিটারের মধ্যে কোনো ইটভাটা নির্মাণ করা যাবে না। এমনকি কৃষিজমিতেও কোনো ইটভাটা বৈধ হিসেবে গণ্য হবে না।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের বাঘিয়া, কাতলাখালী, জয়েরটেক, আহাকী ও রাজাবাড়ী এবং ১২ নম্বর ওয়ার্ডের বাইমাইল, সিটির সালনা, নছের মার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে শতাধিক ইটভাটা। এসব ইটভাটা বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসা এবং আবাসিক এলাকার আশপাশে গড়ে উঠেছে। অথচ গাজীপুর সিটি করপোরেশন ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই এসব এলাকার ইটভাটার পরিবেশগত ছাড়পত্র, জেলা প্রশাসকের অনুমোদন ও সিটি করপোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স বন্ধ করে দেওয়া হয়।

গতকাল বিকেলে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার বক্তাবলী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, চারদিকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী। ইটভাটার উঁচু চিমনির কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। কালো ধোঁয়া বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশ ধোঁয়ায় অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শ্রমিক বলেন, প্রতিদিন তাঁদের ইটের ভাটায় সাড়ে তিন টন কয়লা পোড়ানো হয়। পোড়ানো হয় ৩০ হাজার ইট। জিগজ্যাগ ইটভাটাগুলোতে কালো ধোঁয়া বের হওয়া প্রসঙ্গে শ্রমিকেরা জানান, কয়লা দেওয়ার সময় জিগজ্যাগ থেকেও প্রথম ১ থেকে ৫ মিনিট কালো ধোঁয়া বের হবে। পরে আর কালো ধোঁয়া বের হবে না। আধা ঘণ্টা পর ভাটার চুল্লিতে নতুন করে কয়লা দেওয়া হয়।

পরিবেশবিদেরা বলছেন, আইন অনুযায়ী দেশের ৯০ শতাংশ ইটভাটাই অবৈধ। এমনকি পরিবেশবান্ধব আধুনিক প্রযুক্তিতে রূপান্তরিত ইটভাটাগুলো আসলে কতটুকু কার্যকরভাবে এসব প্রযুক্তি স্থাপন করেছে, তারও কোনো সামগ্রিক পর্যালোচনা এখনো পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, যেসব প্রযুক্তিকে পরিবেশবান্ধব বলা হচ্ছে, তার মধ্যেও অনেক গলদ আছে। সেগুলো নানা ধরনের দূষণ ঘটাচ্ছে। দেশের বায়ুর মানমাত্রা বজায় রেখে সব কটি ইটভাটা পরিচালিত হচ্ছে কি না, তার একটি সামগ্রিক সমীক্ষা দরকার উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ইটভাটাগুলোকে পরিবেশবান্ধব করতে না পারলে বায়ুদূষণ থেকে আমাদের মুক্তি নেই।’

(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছে গাজীপুর প্রতিনিধি মাসুদ রানা এবং নারায়ণগঞ্জের প্রতিনিধি মুজিবুল হক)