সাড়ে ১৫ কোটি টাকার কেনায় বড় 'অনিয়ম'

শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ, হবিগঞ্জ। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ, হবিগঞ্জ। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

৪২ হাজার টাকার ল্যাপটপ কেনা হয়েছে ১ লাখ ৪৮ হাজার টাকায়। ৬০ হাজার টাকার কালার প্রিন্টারের দাম পড়েছে ২ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। ৩৯ হাজার টাকার রেফ্রিজারেটর ৮৫ হাজার টাকায় কেনা হয়েছে। এমনকি মানবদেহের মেডিকেল চার্ট; বাজারে যার দাম ৫০০ টাকা, তা কেনা হয়েছে ৭ হাজার টাকায়।

হবিগঞ্জের শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজে এভাবে বেশি দামে কম্পিউটার, আসবাব, চিকিৎসা সরঞ্জামাদি কেনার অভিযোগ উঠেছে। এসব সামগ্রী কেনায় ব্যয় হয়েছে সাড়ে ১৫ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের জুনে ঠিকাদার মালামাল সরবরাহ করেন।

জানতে চাইলে কলেজের অধ্যক্ষ আবু সুফিয়ান প্রথম আলোকে বলেন, নীতিমালা অনুযায়ী দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। সার্ভে কমিটির মাধ্যমে ঠিকাদার মালামাল সরবরাহ করেছেন। পাশাপাশি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ প্রশাসনিক ব্যয়েরও অনুমোদন দেয়। এখানে অনিয়ম হলে দরপত্র বিষয়ে যে চারটি কমিটি রয়েছে, সেসব কমিটির সদস্যরা সম্মতি ও স্বাক্ষর করতেন না।

শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৮ সালের ১০ জানুয়ারি। হবিগঞ্জ আধুনিক সদর হাসপাতালের ২৫০ শয্যার নতুন ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় কলেজটির অস্থায়ী ক্যাম্পাস। বর্তমানে শিক্ষার্থী ১৫০ জন।

কলেজের একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কম্পিউটার, আসবাব, মেডিকেল সরঞ্জামাদি ক্রয়ের জন্য ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কলেজ কর্তৃপক্ষ ২০১৮ সালের জুনে দরপত্র আহ্বান করে। এতে সাতটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। কাজ পায় ঢাকার নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজ ও পুনম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল।

মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ আবু সুফিয়ানকে সভাপতি ও জেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের উপপরিচালক নাসিমা খানমকে সদস্যসচিব করে সাত সদস্যের দরপত্র প্রস্তাব ও মূল্যায়ন কমিটি গঠন করা হয়। কলেজ কর্তৃপক্ষ ১৩ কোটি ৮৭ লাখ হাজার ১০৯ টাকায় ৫১৮ ধরনের মালামাল ক্রয় করে। ভ্যাটসহ মোট খরচ দেখানো হয় ১৫ কোটি ৪৯ লাখ ৭৮ হাজার ৮৫৭ টাকা। এর মধ্যে ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকার চিকিৎসাবিষয়ক বইপত্র ও সাময়িকী, ৫ কোটি টাকার চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম, ১ কোটি ৫০ লাখ টাকার কম্পিউটার যন্ত্রাংশ, ১ কোটি টাকার আসবাব, ৩ কোটি ৪০ লাখ টাকার এমএসআর (মেডিকেল অ্যান্ড সার্জিক্যাল রিকয়ারমেন্ট)। নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজ সরবরাহ করে ৯ কোটি ৩৭ লাখ ৮৭ হাজার ৪০৯ টাকার মালামাল। বাকিটা পুনম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল সরবরাহ করে।

নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজের সরবরাহ করা ৬৭টি লেনোভো ল্যাপটপের (মডেল ১১০ কোর আই ফাইভ) দাম ধরা হয়েছে ৯৯ লাখ ৪৯ হাজার ৫০০ টাকা; প্রতিটির দাম ১ লাখ ৪৮ হাজার ৫০০ টাকা। তবে বাজারে এই মডেলের ল্যাপটপ বিক্রি হচ্ছে ৪২ হাজার টাকায়। এইচপি কালার প্রিন্টারের (মডেল জেড প্রো এম ৪৫২এন ডব্লিউ) দাম নেওয়া হয় ২ লাখ ৪৮ হাজার ৯০০ টাকা। তবে বাজারে এর দাম ৬০ হাজার টাকা। ৫০ জন বসার জন্য কনফারেন্স টেবিল, এক্সিকিউটিভ চেয়ার ও সাউন্ড সিস্টেমে ব্যয় ধরা হয় ৬১ লাখ ২৯ হাজার টাকা। ঠিকাদারের সরবরাহ করা ফার্নিচারে নাম রয়েছে ইয়ামিন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের শীর্ষস্থানীয় ফার্নিচারের চেয়ে এর দাম কয়েক গুণ বেশি। এ ছাড়া ৬ হাজার ৪৭৫টি চিকিৎসাবিষয়ক বইয়ের মূল্য ৪ কোটি ৪৯ লাখ ৮ হাজার ৬৬৪ টাকা।

এ বিষয়ে জানতে নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজের ভাউচারে দেওয়া মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে কেউ ফোন ধরেননি। খুদে বার্তা পাঠালেও সাড়া পাওয়া যায়নি।

পুনম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ৮১টি কার্লজিস প্রিমো স্টার বাইনোকুলার মাইক্রোস্কোপ সরবরাহ করেছে। দাম দেখানো হয়েছে ২ কোটি ৬৩ লাখ ৩২৫ টাকা। অর্থাৎ প্রতিটির দাম পড়েছে ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা। তবে বাজারে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩০০ টাকায় কেনা সম্ভব। জেনারেল কোম্পানির ৩১টি এসি (দুই টন) কেনা হয়েছে। প্রতিটির মূল্য ধরা হয়েছে ১ লাখ ৯৮ হাজার টাকা। তবে বাজারে এর দাম ৮৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া ওয়ালটনের মাঝারি সাইজের ছয়টি রেফ্রিজারেটর কেনা হয়েছে, যার প্রতিটির মূল্য ৮৫ হাজার টাকা। তবে ওয়ালটনের স্থানীয় পরিবেশকের ব্যবস্থাপক শাহীন মাহমুদ জানান, তাঁদের এই রেফ্রিজারেটর ৩৯ হাজার ৩৯০ টাকায় বিক্রি হয়। গবেষণাগারে ব্যবহারের জন্য ডিজিটাল ওয়েইংয়ের (ওজন মাপার যন্ত্র) মূল্য ধরা হয় ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা। বাজারে এর দাম ৪০ হাজার টাকা। এ ছাড়া মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ছবিসংবলিত কাগজে ছাপা চার্ট বাজারে ১০০ থেকে ৫০০ টাকায় পাওয়া যায়। কলেজ কর্তৃপক্ষ প্রতিটি চার্ট কিনেছে ৭ হাজার ৮০০ টাকায়।

ঢাকার মতিঝিলে অবস্থিত পুনম ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে যোগাযোগ করলে প্রতিষ্ঠানের মহাব্যবস্থাপক মফিজুল ইসলাম বলেন, এ বিষয়ে তাঁর বিস্তারিত জানা নেই। কারণ, তিনি এ প্রতিষ্ঠানে সদ্য যোগদান করেছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মেডিকেল কলেজের একজন শিক্ষক বলেন, চিকিৎসা বিষয়ের ওপর যেসব বই কেনা হয়েছে, সেগুলো এমবিবিএস কোর্সের কাজে আসবে না। কারণ, এসব বই গবেষণার কাজে ব্যবহৃত হয়। কলেজের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা ২০২২ সালে পঞ্চম বর্ষে পদার্পণ করবেন। যখন সিলেবাস পরিবর্তন হবে, তখন বইগুলো আর কাজে আসবে না।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) হবিগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান বলেন, এখানে পাঁচ থেকে ছয় কোটি টাকার মালামাল কেনা হয়েছে। বাকি টাকা আত্মসাৎ হয়েছে।