ছেলেধরা গুজবে নারীকে হত্যায় ৫০ জন জড়িত থাকার তথ্য, তদন্ত ডিবিতে

গণপিটুনিতে নিহত তাসলিমা বেগম। ছবি: সংগৃহীত
গণপিটুনিতে নিহত তাসলিমা বেগম। ছবি: সংগৃহীত

বাড্ডায় স্কুল প্রাঙ্গণে ছেলেধরা গুজবে তাসলিমা বেগম ওরফে রেনু (৪০) হত্যার ঘটনায় পুলিশ অন্তত ৫০ জনের জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছে। পুলিশ বলেছে, গত জুলাইয়ের ওই ঘটনায় এ পর্যন্ত ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

তাসলিমার চার বছর বয়সী মেয়েটি এখনো জানে না, তার মা নেই। প্রতি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে মায়ের জন্য কান্নাকাটি করে মেয়েটি। এদিকে ঘটনার চার মাস পেরিয়ে গেলেও পুলিশ হত্যা মামলার তদন্ত শেষ করতে পারেনি। এ নিয়ে হতাশার কথা জানাল তাসলিমার পরিবার। সম্প্রতি মামলার তদন্তভার পেয়েছে ডিবি।

গত ২০ জুলাই সকালে উত্তর-পূর্ব বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাসলিমা তাঁর চার বছরের মেয়েকে ভর্তি করানোর বিষয়ে খোঁজ নিতে যান। সেখানে উপস্থিত কয়েকজন নারী তাঁকে ‘ছেলেধরা’ সন্দেহ করেন। এই গুজব দ্রুত বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। আশপাশ থেকে বিভিন্ন বয়সী কয়েক শ নারী-পুরুষ স্কুল প্রাঙ্গণে ঢুকে পড়ে। তাদের কবল থেকে রক্ষা করতে তাসলিমাকে স্কুলের দোতলায় প্রধান শিক্ষকের কক্ষে নিয়ে রাখা হয়। কিন্তু কিছু উচ্ছৃঙ্খল মানুষ কলাপসিবল গেট ভেঙে দোতলায় প্রধান শিক্ষকের কক্ষ থেকে তাসলিমাকে টেনেহিঁচড়ে নিচে নামিয়ে এনে কিল, ঘুষি, লাথি মারতে থাকে। এভাবে আধ ঘণ্টা অমানবিক নির্যাতনের পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তাসলিমা।

তাসলিমার ভাগনে সৈয়দ নাসির উদ্দিন ওই ঘটনায় অজ্ঞাতনামা ৪০০-৫০০ ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা করেছিলেন। মামলাটি তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)।

তাসলিমার স্বজনেরা জানান, মায়ের জন্য তাসনিম মাহিরা ওরফে তুবার কান্না থামছে না। মাকে ছাড়া সে খেতে চায় না। সে তার বড় খালার বাসায় আছে। ছোট্ট তাসনিম ঘুমাতে গিয়ে প্রতি রাতে তার মায়ের জন্য বিলাপ করে বলে, ‘আমি মাকে ছাড়া ঘুমাব না, তোমরা আমার মাকে এনে দাও।’ মায়ের কথা জানতে চাইলে তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলা হয়, মা তার মামার সঙ্গে বিদেশে আছে। সেখান থেকে শিগগির ফিরে আসবে।

দুই বছর আগে তাসলিমার সঙ্গে তাঁর স্বামী তসলিম হোসেনের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এরপর তাঁদের এক সন্তান তাসনিম তার মায়ের সঙ্গে মহাখালীর ওয়ারলেস গেটসংলগ্ন ভাড়া বাসায় থাকত। আরেক ছেলে তাহসিন আল মাহিদ (১১) তার বাবার সঙ্গে বাড্ডায় থাকত। সম্প্রতি বাবা (তসলিম) আরেকটি বিয়ে করায় স্বজনেরা মাহিদকে তার বড় খালার বাসায় নিয়ে আসে। এখন দুই ভাইবোনের আশ্রয় হয়েছে বড় খালার বাসায়। এবার প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা থাকলেও পারিবারিক অস্থিরতার কারণে মাহিদ পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি।

তাসলিমা ইডেন কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করেছিলেন। পরে তিনি সরকারি তিতুমীর কলেজে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর করেন। বিয়ের পর তিনি আড়ং ও ব্র্যাকে চাকরি করেন। বড় ছেলের বয়স যখন দেড় বছর, তখন তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। তাসলিমা দেড়-দুই বছর আগে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসা করানোর পর তিনি সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন।

এদিকে চার মাস পর বাড্ডা থানা থেকে গত রোববার তাসলিমা হত্যা মামলার তদন্তভার ডিবিতে দেওয়া হয়। মামলা তত্ত্বাবধানকারী ডিবির পূর্ব বিভাগের উপকমিশনার মো. ইলিয়াছ শরীফ প্রথম আলোকে বলেন, ডিবি মামলার তদন্তভার পেয়েছে। ডিবি এখন হত্যায় জড়িত সবাইকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করবে এবং অভিযোগপত্র জমা দেবে।

মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তাসলিমা হত্যায় গ্রেপ্তার ১৪ জন কারাগারে আছেন। তাঁদের মধ্যে রিয়া বেগম ওরফে ময়না (২৭), হৃদয় ইসলাম মোল্লা ওরফে ইব্রাহীম (২০) ও জাফর হোসেন (১৮) আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। হৃদয় ইসলাম মামলার প্রধান আসামি। তিনি স্কুলের পাশে সবজি বিক্রি করতেন। তিনিই তাসলিমাকে প্রথমে লাঠিপেটা করেন।

তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ডিবির জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার নাজমুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, আলোচিত তাসলিমা হত্যায় ভিডিও ফুটেজ ও স্থির ছবি বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন বয়সের অন্তত ৫০ জন নারী-পুরুষের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা গেলেও বাকিদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

মামলার বাদী তাসলিমার ভাগনে সৈয়দ নাসির উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, মামলার তদন্ত নিয়ে তাঁরা হতাশ। বাড্ডা থানার পুলিশ মামলার তদন্তে অনেক কালক্ষেপণ করেছে। নৃশংস হত্যায় যারা জড়িত, তাদের গ্রেপ্তার করে এখন ডিবি আদালতে অভিযোগপত্র দেবে।