পেট্রলপাম্পে ধর্মঘট, গাড়ির চালক ও মালিকেরা বিপাকে

তেল বিক্রির কমিশন বৃদ্ধি, পেট্রলপাম্প-সংলগ্ন জমির ইজারা বাতিলসহ ১৫ দফা দাবিতে পেট্রল পাম্পে অনির্দিষ্টকাল কর্মবিরতি শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ পেট্রলপাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন ও ট্যাংকলরি মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদের ডাকে এই কর্মবিরতি হচ্ছে। রংপুর, ১ ডিসেম্বর। ছবি: প্রথম আলো
তেল বিক্রির কমিশন বৃদ্ধি, পেট্রলপাম্প-সংলগ্ন জমির ইজারা বাতিলসহ ১৫ দফা দাবিতে পেট্রল পাম্পে অনির্দিষ্টকাল কর্মবিরতি শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ পেট্রলপাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন ও ট্যাংকলরি মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদের ডাকে এই কর্মবিরতি হচ্ছে। রংপুর, ১ ডিসেম্বর। ছবি: প্রথম আলো

কোথাও রশি টানিয়ে, কোথাও ড্রাম ও প্লাস্টিকের খুঁটি দিয়ে প্রবেশপথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। বন্ধ ক্যাশ কাউন্টার। বিক্রয়কর্মীরা বসে অলস সময় কাটাচ্ছেন। নেই প্রাণচাঞ্চল্য। আজ রোববার সকাল থেকে এ চিত্র বিরাজ করছে বগুড়ার অর্ধশতাধিক পেট্রলপাম্পে।

জ্বালানি তেল বিক্রির কমিশন বৃদ্ধি, ট্যাংকলরির ভাড়া বৃদ্ধি, পেট্রলপাম্পের জন্য কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের লাইসেন্স গ্রহণ প্রথা বাতিল করাসহ ১৫ দফা দাবিতে বাংলাদেশ পেট্রলপাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং পেট্রলপাম্প ও ট্যাংকলরি মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের ডাকে আজ সকাল ছয়টা থেকে রাজশাহী, রংপুর ও খুলনা বিভাগে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটে চলছে। সেই ধর্মঘটে সাড়া দিয়ে সব ধরনের জ্বালানি তেল বিক্রি, পরিবহন ও উত্তোলন বন্ধ রেখেছেন বগুড়া, ঝিনাইদহ, যশোর, মেহেরপুর ও নাটোরের পেট্রলপাম্পের মালিকেরা। এই ধর্মঘটের কারণে বিভিন্ন যানবাহনের চালক ও মালিকেরা বিপাকে পড়েছেন। ডিজেল না পেয়ে কৃষকেরাও জমিতে সেচ দিতে পারছেন না। এতে কৃষি কর্মকর্তারা ফলন বিপর্যয়ের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

আজ সকালে সরেজমিনে দেখা গেছে, বগুড়া শহরের চারমাথা, তিনমাথা, সিলিমপুর, বনানী মোড়ের পেট্রলপাম্পগুলো বন্ধ। পাম্পের সামনে রশি টানিয়ে, ড্রাম ও প্লাস্টিকের খুঁটি রেখে পাম্পে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

পেট্রলপাম্প বন্ধ থাকায় জ্বালানি তেল নিতে এসে ফিরে যাচ্ছে অনেক যানবাহন। মোটরসাইকেলের চালকেরা পাম্পে তেল না পেয়ে ছুটছেন খুচরা জ্বালানি তেল বিক্রির দোকানে। সেখানে পেট্রল ও অকটেন কেনার জন্য ভিড় করছেন মোটরসাইকেলের চালকেরা। সকালে বনানী মোড়ের একটি পেট্রলপাম্পে মোটরসাইকেল নিয়ে তেল কিনতে এসে না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা ইমরান হোসেন। তিনি বললেন, ‘টাঙ্গাইল থেকে রংপুর যাচ্ছি। বগুড়ায় এসে মোটরসাইকেলে পেট্রল ফুরিয়েছে। কিন্তু পাম্প বন্ধ। তেল পাচ্ছি না। বাধ্য হয়ে শহরের খুচরা দোকানে যাচ্ছি।’

বগুড়া শহরের মফিজপাগলার মোড়ে সুলতান মবিলে সকাল নয়টার দিকে মোটরসাইকেলে তেল কেনার জন্য দীর্ঘ লাইন দেখা গেল। দোকানের ব্যবস্থাপক বলেন, সকাল থেকে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন মোটরসাইকেলের চালকেরা। দোকানে পেট্রল ও অকটেনের মজুতও প্রায় শেষের দিকে। অনেকেই ১০ লিটার পর্যন্ত জ্বালানি তেল চাচ্ছেন। একজন চালককে সর্বোচ্চ দুই লিটার তেল দেওয়া হচ্ছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ পেট্রলপাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কমিটির একাংশের মহাসচিব এবং পেট্রলপাম্প ও ট্যাংকলরি মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের রাজশাহী বিভাগীয় কমিটির আহ্বায়ক মিজানুর রহমান আজ সকালে প্রথম আলোকে বলেন, তিন বিভাগে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধর্মঘট চলছে। দাবি আদায় না হলে সারা দেশে এ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হবে।

পেট্রলপাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতা মিজানুর রহমান আরও বলেন, সড়ক ও জনপথ বিভাগ নির্ধারিত পেট্রলপাম্প-সংলগ্ন জমির ভাড়া বাবদ একজন পেট্রলপাম্প মালিককে বছরে গড়ে ১৫ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। সেই ভাড়ার টাকা ১০ বছরের জন্য অগ্রিম পরিশোধ করতে হচ্ছে। এভাবে দেড় কোটি টাকা জায়গার ভাড়া দিয়ে পেট্রলপাম্পের ব্যবসা করা সম্ভব নয়।

আজ সকাল ছয়টা থেকে কুষ্টিয়া জেলার সব পেট্রলপাম্প বন্ধ ছিল। এতে মোটরসাইকেলের চালকসহ বিভিন্ন যানবাহনের চালকেরা ভোগান্তিতে পড়েন। তবে কয়েকটি পাম্পে সরকারি গাড়িতে তেল সরবরাহ করছে পাম্পগুলো।

কয়েকজন পেট্রলপাম্প মালিক ও শ্রমিকেরা বলেন, খুলনা বিভাগের ট্যাংকলরি মালিক-শ্রমিক ও জ্বালানি তেল ব্যবসায়ীরা আজ থেকে এই কর্মবিরতি পালনের ঘোষণা দেওয়ায় তাঁদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে এই কর্মবিরতি পালন করছেন তাঁরা।

বেলা পৌনে ১১টায় শহরের কয়েকটি পেট্রলপাম্পে গিয়ে দেখা যায়, মোটরসাইকেলের চালক ও বাসের চালকেরা তেল নিতে গেলে তাঁদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তবে সরকারি গাড়ি গেলে তাদের জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হচ্ছে।

ঝিনাইদহেও পেট্রলপাম্পগুলোতে চলছে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট। সকাল থেকে জ্বালানি তেল বিক্রি বন্ধ রেখে কর্মবিরতি পালন করছেন পাম্পগুলোর মালিক ও শ্রমিকেরা। আজ জ্বালানি তেল না পেয়ে অনেককে পাম্প থেকে ফিরে যেতে দেখা গেছে। জ্বালানি তেলের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে বেশ কিছু বাস ও ট্রাক। এ বিষয়ে মোটরসাইকেলের চালক সাদ্দাম হোসেন জানান, শহর থেকে কালীগঞ্জ যাওয়ার জন্য জ্বালানি তেল নিতে এসে পেট্রলপাম্প বন্ধ পান তিনি। এখন বাসায় ফিরে যেতে হচ্ছে। ঝিনাইদহ শহর থেকে হরিণাকুণ্ডুগামী এক ব্যক্তি বলেন, ‘প্রতিদিন সকালে শহর থেকে হরিণাকুণ্ডু উপজেলায় গিয়ে অফিস করতে হয়। পেট্রলপাম্পে সকালে তেল নিতে এসে দেখি তেল বিক্রি বন্ধ। এ অবস্থায় অফিসে যেতে পারছি না।’ শৈলকুপা উপজেলার গাড়াগঞ্জ এলাকায় জেভি ফিলিং স্টেশনের মালিক নায়েব আলী জোয়ার্দ্দার জানিয়েছেন, তাঁরা ১৫ দফা দাবিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট শুরু করেছেন। সব পেট্রলপাম্প বন্ধ।

যশোরের বিভিন্ন এলাকার পেট্রলপাম্পগুলোতে জ্বালানি তেল বিক্রি বন্ধ রয়েছে। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে দেখা যায়, সদর উপজেলার কেসমত নওয়াপাড়া এলাকার রজনীগন্ধা ফিলিং স্টেশন ও উপশহর ফিলিং স্টেশনের তেল বিক্রি বন্ধ। জ্বালানি তেল না পেয়ে বাঘারপাড়া উপজেলার সিঙ্গিয়া ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক প্রদীপ বিশ্বাস বলেন, ‘ধর্মঘট চালানোর বিষয়টি আমার জানা ছিল না। সকালে মোটরসাইকেল নিয়ে পাম্পে জ্বালানি তেল নিতে গিয়ে দেখি, তেল বিক্রি বন্ধ রয়েছে। প্রতিদিন মোটরসাইকেলে ২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে কলেজে যেতে হয়। তেল না পাওয়ায় খুবই বিপদে পড়েছি।’

যশোর-নড়াইল সড়কে বাঘারপাড়া উপজেলার বর ফিলিং স্টেশনের অংশীদার মাহবুব হাসান বলেন, ‘জ্বালানি তেল বিক্রির কমিশন বৃদ্ধি, তেলবাহী ট্যাংকলরি দুর্ঘটনায় কেউ নিহত হলে কমপক্ষে ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ, পেট্রলপাম্পের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের লাইসেন্স গ্রহণ বাতিল করাসহ ১৫ দফা দাবিতে আমাদের ধর্মঘট চলছে। দাবি না মানা পর্যন্ত এ ধর্মঘট চলবে।’

সকাল ছয়টা থেকে মেহেরপুরের পেট্রলপাম্পগুলোতে ধর্মঘট চলছে। সকালে সরেজমিনে দেখা গেছে, জেলা শহরের পাঁচটি পেট্রলপাম্প বন্ধ রয়েছে। মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার, বাস, ট্রাকচালকেরা এখানে এসে জ্বালানি তেল না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে জেলা পাম্প মালিক সমিতির সভাপতি নুর হোসেন বলেন, এটি কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত। দাবি না মানা পর্যন্ত জ্বালানি তেল বিক্রয় বন্ধ থাকবে। ট্রাকচালক মেহের আলী বলেন, বরিশালে সবজি নিয়ে যাওয়ার চুক্তি ছিল। কিন্তু জ্বালানি তেলের অভাবে ট্রাক চালানো যাচ্ছে না। এভাবে পাম্প বন্ধ থাকলে জেলার একটি ট্রাকও ভাড়ায় যেতে পারবে না। মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, বোরো মৌসুমে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুব কম। এই মৌসুমে বোরো ধান মূলত সেচনির্ভর। জেলার কৃষকদের ধানে সেচ দিতে হচ্ছে দুই দিন পরপর। শ্যালো ইঞ্জিন চালিয়ে সেচ দেওয়ার জন্য ডিজেল প্রয়োজন। কৃষকেরা সময়মতো ধানের জমিতে সেচ দিতে না পারলে ফলন বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে।

ভোর থেকে নাটোরের ২৬টি পেট্রলপাম্পে চলছে ধর্মঘট। সড়কে মোটরযান চলছে সীমিত পরিসরে। সকালে সরেজমিনে দেখা গেছে, নাটোর শহরের মাদ্রাসা মোড়ের কয়েকটি পেট্রলপাম্পের প্রবেশপথে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে ধর্মঘটের নোটিশ। নাটোরের বড়াইগ্রামের বনপাড়ার মদিনা ফিলিং স্টেশনের স্বত্বাধিকারী মঞ্জুরুল ইসলাম জানান, তাঁরা নিরুপায় হয়ে ধর্মঘটে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এ জন্য মোটরগাড়ির মালিক-শ্রমিকসহ পথচারীদের সাময়িক অসুবিধা হচ্ছে। এ জন্য তাঁরা দুঃখিত।

পেট্রলপাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন রাজশাহী বিভাগীয় সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম জানান, দাবি আদায়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার আবেদন করে কোনো ফল পাওয়া যায়নি। এ কারণে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা ধর্মঘট চালিয়ে যাবেন।

[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, বগুড়া ও ঝিনাইদহ; যশোর অফিস এবং প্রতিনিধি, মেহেরপুর ও নাটোর]