রংপুরে তিন ঘাটে সেতু নেই, দুর্ভোগ

যমুনেশ্বরী নদীতে সেতু নির্মাণ না হওয়ায় লোকজন বাঁশের তৈরি পুরোনো নড়বড়ে সাঁকো দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হচ্ছে। রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার জয় বাংলা ঘাটে।  ছবি: প্রথম আলো
যমুনেশ্বরী নদীতে সেতু নির্মাণ না হওয়ায় লোকজন বাঁশের তৈরি পুরোনো নড়বড়ে সাঁকো দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হচ্ছে। রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার জয় বাংলা ঘাটে। ছবি: প্রথম আলো

রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে যমুনেশ্বরী নদী। এই নদীর গুরুত্বপূর্ণ তিনটি ঘাট হলো মণ্ডলপাড়া, কালারঘাট ও জয়বাংলাঘাট। এই তিনটি ঘাঁট দিয়ে উপজেলার সবচেয়ে বেশি মানুষ চলাচল করে থাকে। অথচ এই তিনটি ঘাটে সেতু না থাকায় ৩২টি গ্রামের ৫০ হাজারের বেশি মানুষ যাতায়াতে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।

উপজেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে কুর্শা ইউনিয়নের মণ্ডলপাড়াঘাট। এ খেয়াঘাটের দুই পারে মণ্ডলপাড়া, কবিরাজপাড়া, খিয়ারপাড়া, হাজিপাড়া, কুঠিপাড়া, জুম্মাপাড়া সরকারপাড়া, জলুবার, বানিয়াপাড়া, নদীর পারসহ ১০টি গ্রাম আছে। দীর্ঘদিনেও সেতু নির্মিত না হওয়ায় ওই গ্রামগুলোর প্রায় ২০ হাজার মানুষকে সাঁকো দিয়ে পারাপার হয়ে উপজেলা সদরে যেতে হয়।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, মণ্ডলপাড়া খেয়াঘাটে বাঁশের তৈরি সাঁকোটি ভেঙে পানিতে তলিয়ে গেছে। ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ এখন ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় করে নদী পার হচ্ছে। এ সময় কথা হয় হাজীপাড়া গ্রামের বৃদ্ধা সাইফুল ইসলামের (৭০) সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বাবা, হামার খুব দুর্গতি হইছে। বাঁশের সাঁকোখান ভাঙি তলে গেইছে। একনা নৌকাত সবাকে যাওয়া–আইসা কইরার নাগোছে।’

ঘাটের পাশে ভুট্টাখেতে কাজ করছিলেন মণ্ডলপাড়া গ্রামের দিনমজুর আফজাল হোসেন (৪২)। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘এটে সেতুকোনা বানেবার জন্যে হামরা গ্রামের লোকজন একটে হয়া দুইবার নৌকাত, একবার ধানের শীষোত, দুইবার লাঙ্গল মার্কাত ভোট দিছিনো। কিন্তুক সেতু পাই নাই।’ আফজাল হোসেনের সঙ্গে ভুট্টাখেতে কাজ করছিলেন বানিয়াপাড়া গ্রামের আরেক দিনমজুর সোলেমান হোসেন (৬০)। তিনিও সুর মিলিয়ে বলেন, ‘ভোট আসলে নেতারা দিনে রাইতে বাড়ি ঘরোত পাক পারি কয়, তোমার নদীটা তো বড় সমস্যা। ভোট দেও। এবার ব্রিজ হয়া যাইবে। হামরা তাতে মাতি ভোট দেই। কিন্তু ব্রিজ তো পাই না।’

উপজেলা সদর থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে যমুনেশ্বরী নদীর আরেক ঘাট কালারঘাট। এটি পড়েছে সয়ার ইউনিয়নে। এ খেয়াঘাটের দুই পারে শাহপাড়া, কাংলাচড়া, উজিয়াল, চারআনী, দোলাপাড়া, বুড়িরহাট চিলাপাক, চাকলাসহ রয়েছে ১২টি গ্রাম। এসব গ্রামে প্রায় ১৬ হাজার মানুষের বসবাস। এলাকাবাসী চাঁদা তুলে ঘাটে সাঁকো বানালেও বর্ষাকালে যমুনেশ্বরী নদীর পানি বেড়ে সেটি ডুবে যায়। তখন নৌকা বা কলার ভেলাই ভরসা।

ওই খেয়াঘাটের পাশেই কথা হয় কালারঘাট গ্রামের কৃষক মনিরুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সরকার কত কিছু করে, খালি হামার গ্রামের কাছত পুলকোনা বানেবার না পারে। এটে একনা পুলের জন্য হামার কষ্ট চিরকাল।’ সয়ার ইউনিয়নের পরিষদের সদস্য অহিদুল ইসলাম বলেন, নির্বাচনের আগে ওই স্থানে সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন সব প্রার্থী। নির্বাচন হয়ে গেলে আর কোনো খোঁজ থাকে না। সেতু নির্মাণ না করায় ১২টি গ্রামের কৃষকেরা ধান, পাট, আলুসহ সবজির ভালো দাম পাচ্ছেন না।

স্থানীয় চিলাপাক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আনছার আলী বলেন, কালারঘাটে সেতু না থাকায় বর্ষাকালে নদীর ওপারের উজিয়াল, শাহপাড়া, চারআনী গ্রামের বেশির ভাগ শিশু ভয়ে স্কুল আসতে চায় না। চিলাপাক উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সরফরাজ আলম বলেন, সেতুর অভাবে ১২টি গ্রামের কৃষি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে।

কুর্শা ইউনিয়নের যমুনেশ্বরী নদীরআরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাট জয়বাংলা খেয়াঘাট। উপজেলা সদর থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে ওই খেয়াঘাটে সেতু নির্মাণ না করায় বাঁশের সাঁকো দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে ১০টি গ্রামের মানুষ পারাপার হচ্ছে।

ওই খেয়াঘাটে কথা হয় নদীরপাড় গ্রামের কৃষক সাইবুল ইসলামের (৩৫) সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘হামার ঘাটোত সেতু নাই। কষ্টের ফসল হাটোত নিগি বেচপার পাই না। কম দামে বাড়িতে পাইকারোক দিবার নাগে। এই ভাঙা বাঁশের সাঁকোকোনা দেখছেন, এইকনা খড়ার সময় একমাত্র ভরসা। বর্ষা হইলে কী যে যন্ত্রণা হয়, বলি বুঝির পামো না হামরা।’

খেয়াঘাটের পশ্চিমে গাছতলায় বসে গল্প করছিলেন জয়বাংলা গ্রামের কৃষক মোফাজ্জল হোসেন ও ইকরামুল হক। জানতে চাইলে মোফাজ্জল হক ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘বাবা, হামরা চাইছি সেতু। সরকার বানাওছে পাকা রাস্তা। সেতু ছাড়া জয়বাংলা-মণ্ডলটারী পাকা রাস্তা দিয়া যামো কেমন করিয়া।’

কুর্শা ইউনিয়নের ইউপি সদস্য তুহিনুর ইসলাম বলেন, হাজারো মানুষ দাবি করেও জয়বাংলার ঘাটে একটি পাকা সেতু পাচ্ছে না—এর চেয়ে লজ্জাজনক আর কী হতে পারে। আর কতকাল সেতুর অভাবে ১১টি গ্রামের ১৪ হাজার মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হবে?

এ বিষয়ে উপজেলা প্রকৌশলী আহাম্মেদ হায়দার জানান, ওই খেয়াঘাটগুলো ঘুরে সেতু নির্মাণের জন্য বরাদ্দ চেয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ঢাকায়
পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলেই পর্যায়ক্রমে সেতু নির্মাণ করা হবে।