বাবা খুন, মা জেলে, কী হবে তিন সন্তানের?

কিশোরগঞ্জের ভৈরবে খুন হওয়া রেলওয়ের কর্মচারী মাহাবুবুর রহমান।
কিশোরগঞ্জের ভৈরবে খুন হওয়া রেলওয়ের কর্মচারী মাহাবুবুর রহমান।

সামিউল হক পড়ছে চতুর্থ শ্রেণিতে। আজিজুল হক প্রথম শ্রেণির ছাত্র। আর মাত্র দুই দিন পর তাদের বার্ষিক পরীক্ষা। অথচ পাঁচ দিন ধরে বইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ নেই তাদের। নাওয়া-খাওয়াও প্রায় ছেড়ে দিয়েছে এই সহোদর। তাদের বাবা মাহাবুবুর রহমান খুন হয়ে এখন পরবাসী। আর খুনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ থাকায় মা রোকসানা আক্তার আছেন কারাগারে।

নিজের শোবার ঘরে গত বুধবার রাতে খুন হন মাহাবুবুর (৩৫)। তিনি বাংলাদেশ রেলওয়ে ঢাকা বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশল বিভাগের এসএস ফিটার পদে কর্মরত ছিলেন। বাড়ি কিশোরগঞ্জের ভৈরব পৌর শহরের চণ্ডীবের উত্তরপাড়ায়।

গত রোববার সন্ধ্যায় কিশোরগঞ্জের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. শহীদুল ইসলাম চৌধুরীর কাছে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন রোকসানা (৩০) ও মাহাবুবুরের চাচাতো ভাই মো. আসিফ (২২)। এরপর থেকে আসিফের পাশাপাশি রোকসানার স্থান হয় কারাগারে। জবানবন্দিতে উভয়ে উল্লেখ করেন, ছয় মাস আগে থেকে তাঁরা প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। সেই প্রেমের সূত্র ধরে মাহাবুবুর খুন হন।

অকস্মাৎ মা-বাবাকে হারিয়ে তাদের তিন সন্তান দিশেহারা। আজিজুল ও সামিউল বাবার বাড়িতে অবস্থান করলেও তাদের চার বছর বয়সী বোন সাথী রয়েছে নানার বাড়ির লোকজনের হেফাজতে।

গতকাল সোমবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে চণ্ডীবের উত্তরপাড়ার মাহাবুবুরের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, প্রধান ফটকটি তালাবদ্ধ। প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, ঘটনার পর থেকে পুলিশ প্রশাসনের নির্দেশে ঘরটি তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। দুই ভাইকে পাওয়া যায় চাচা হাবিবুর রহমানের ঘরে। হাবিবুর হত্যা মামলার বাদী এবং ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সরেজমিন পত্রিকার জ্যেষ্ঠ নিজস্ব প্রতিবেদক।

বড় ভাই আজিজুলকে জড়িয়ে বসে ছিল সামিউল। আজিজুল বলে, ‘ভালো লাগে না। আম্মা নাই। আব্বা মারা গেছে। আর ফিরা আইব না।’

পরীক্ষা কখন, জানতে চাইলে আজিজুল জানায়, ৫ ডিসেম্বর থেকে তাদের দুই ভাইয়ের বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হবে। রুটিনও সংগ্রহ করেছে। কিন্তু ঘটনার পর থেকে পড়ার কথা ভাবতে পারছে না তারা। মন খারাপ করে আজিজুল বলে, ‘মনে হয় পরীক্ষাও দেওয়া আর হইব না।’

ঘটনার রাতে মাহাবুবুর ঢাকা থেকে বাড়িতে ফেরেন। সন্তানেরা গ্রিল কাবাব আর নান রুটি পছন্দ করে, তাই ভৈরব বাসস্ট্যান্ডের একটি রেস্তোরাঁ থেকে গ্রিল আর রুটি সঙ্গে নিয়ে ঘরে আসেন। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে রুটি-কাবাব দিয়ে রাতের খাবার শেষ করে ঘুমিয়ে পড়েন।

দুর্ঘটনার রাতের কথা মনে করে আজিজুল জানায়, ‘আম্মা আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে। জানায় তোর বাবাকে ডাকাতরা মেরে ফেলেছে। এসে দেখি বাবার জামাকাপড় রক্তমাখা। অনেক ডাকাডাকি করেছি। কিন্তু কথা বলেননি। তখন বুঝতে পেরেছি বাবা আর নেই। তখন আমার কেবল বাবার সঙ্গে রাতের খাবারের দৃশ্যটা মনে পড়ছিল।’ চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে আজিজুল জানায়, আর কোনো দিন বাবা তাদের ভাইবোনের জন্য পোড়া মুরগি আর রুটি আনবেন না।

মায়ের কাছ থেকে বাবার খুন হওয়ার কথা শুনে বেশিক্ষণ বাবার কাছে ছিল না আজিজুল। সাহায্যের জন্য দৌড়ে পাশের ঘরে যায়। ওই ঘরটি আসিফের। আসিফ তখন খাটে শুয়ে ছিলেন। আজিজুলের মুখ থেকে বিপদের কথা শুনে অন্যদের মতো তিনিও আঁতকে ওঠেন এবং সাহায্যের জন্য এগিয়ে যান। ঘরে ঢুকেই আসিফ কৌশলে রোকসানার মুঠোফোনটি পকেটে ঢুকিয়ে ফেলেন। এই দৃশ্য দেখে ফেলে আজিজুল। সকালে পুলিশ আসার পর আজিজুল কানে কানে জানায় আসিফের কাছে তার মায়ের মুঠোফোন রয়েছে। পুলিশ বিষয়টি আমলে নেয় এবং আসিফের কাছ থেকে মুঠোফোনটি উদ্ধার করে। পরবর্তী সময়ে ওই মুঠোফোনের সূত্র ধরেই খুনের রহস্য উন্মোচন হয়।

বাবা আর ফিরে আসবে না, এই সত্য আজিজুলের ছোট ভাই সামিউলও বুঝতে পারছে। কিন্তু মা কেন নেই, সেই বিষয়ে তার ধারণা নেই। বড় ভাই আজিজুলের কাছে সামিউলের প্রশ্ন, ‘ভাই, আম্মা কি আর আইব না?’

দাদি রওশন আরা থাকেন ঢাকায় বড় ছেলে হাবিবুরের সঙ্গে। এ মুহূর্তে আজিজুল ও সামিউলের সবকিছু দেখাশোনা করছেন তিনিই। আঁচল দিয়ে চোখ মুছে রওশন আরা বলেন, ‘ছেলে হারালাম। নাতিদের হারাতে চাই না। সবাই ফেলে দিতে পারলেও আমি ফেলতে পারব না। রাখব আমার সঙ্গেই।’

হাবিবুর জানালেন, দুই ভাইকে ঢাকায় নিয়ে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে আছে।