মামলা বেড়েছে, বাড়েনি বিচারক

চট্টগ্রাম নগরে বেড়েছে জনসংখ্যা। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে বাড়ানো হয় থানার সংখ্যা। বাড়ছে মামলার সংখ্যা। কিন্তু মামলাজট কমাতে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেসিতে (মহানগর হাকিম আদালত) বাড়েনি বিচারকের সংখ্যা। বিচারে দীর্ঘসূত্রতায় বাড়ছে বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেসিতে বর্তমানে ৩১ হাজার ৬০৮টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর সঙ্গে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১০০টি নতুন মামলা যোগ হচ্ছে। নগরের ১৬ থানার বাসিন্দারা থানায় কিংবা সরাসরি মহানগর হাকিম আদালতে মামলা করে থাকেন। এসব মামলায় গ্রেপ্তার আসামির জামিন, রিমান্ড শুনানি, জবানবন্দি গ্রহণসহ যাবতীয় কার্যক্রম হয় হাকিম আদালতে। 

বর্তমানে একজন মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম), একজন অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম (এসিএম) এবং ছয়জন মহানগর হাকিম নিয়ে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেসি আদালত পরিচালিত হচ্ছে। অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে তিনটি দ্রুত বিচার আদালত ও একটি বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতেরও দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে বিচারকদের।

এই অবস্থায় মামলাজট কমাতে চট্টগ্রাম মুখ্য মহানগর হাকিম মোহাম্মদ ওসমান গণি সম্প্রতি আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠান। সেখানে চট্টগ্রামে তিনটি অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম এবং ছয়টি মহানগর হাকিমের নতুন পদ সৃষ্টির জন্য প্রস্তাব করা হয়।

চিঠিতে বলা হয়, বর্তমানে প্রতিটি আদালতে ৪ হাজারের বেশি মামলা রয়েছে। নগরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে নতুন অপরাধ ও মামলার সংখ্যা বাড়ছে। আদালতের সংখ্যা বাড়ানো না হলে মামলার সংখ্যা বাড়বে। বিচারপ্রার্থীরা দীর্ঘসূত্রতার কারণে হতাশাগ্রস্ত হয়ে বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারাবে। এর আগে ২০১৩ সালেও আইন মন্ত্রণালয়ে বিচারক বাড়ানোর প্রস্তাব করা হলেও তা কার্যকর হয়নি।

চট্টগ্রাম মহানগর সরকারি কৌঁসুলি মো. ফখরুদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, মামলাজট কমাতে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেসিতে বিচারকের পদ বাড়ানো খুবই প্রয়োজন। অপরাধের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মামলার সংখ্যা বাড়লেও ১১ বছরে একজনও মহানগর হাকিমের পদ বাড়েনি। অথচ ২০০৭ সালের তুলনায় বর্তমানে তিন গুণ মামলা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিদিন যোগ হচ্ছে নতুন মামলা। বিচারকের সংখ্যা না বাড়ায় বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ কমছে না।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে নগরে প্রায় ৭০ লাখ লোকের বসতি রয়েছে। এ ছাড়া প্রতিদিন ১০ হাজারের বেশি লোক নগরে আসা-যাওয়া করে। পুলিশ সূত্র জানায়, নগরে জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে অপরাধও বাড়ছে। তাই অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও পুলিশি সেবা বাড়ানোর জন্য থানার সংখ্যা ছয় থেকে বাড়িয়ে ২০০০ সালে ১২টিতে উন্নীত করা হয়।

সর্বশেষ ২০১৩ সালে আরও চারটি নতুন থানা চালু করা হয়। ২০১৩ সালে চট্টগ্রাম নগরে খুনের ঘটনা ঘটে ৯২টি, ধর্ষণ ৫৮টি ও অপহরণ ১৭টি। পরের বছর তা আরও বেড়ে যায়। ২০১৪ সালের হিসাব অনুযায়ী খুন ১১৮টি, ধর্ষণ ৭৫টি ও অপহরণের ৫৩টি ঘটনা ঘটেছে। পরের বছর আরও বাড়ে। নতুন করে আরও চারটি থানা বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠায় নগর পুলিশ ২০১৬ সালে। এগুলো হলো কুয়াইশ, ফতেয়াবাদ, ভাটিয়ারী ও শিকলবাহা।

নগরে অপরাধ বৃদ্ধির সঙ্গে মামলার সংখ্যাও বেড়েছে বলে জানান চট্টগ্রাম মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের সরকারি কৌঁসুলি মো. আবিদ হোসেন। তিনি জানান, ২০১৮ সালে মামলা হয়েছে ২৬ হাজার। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত হয়েছে ৩০ হাজার মামলা। পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ১ হাজার ৫৫৯টি। বর্তমানে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা বাড়ানো না হলে নিষ্পত্তিতে বছরের পর বছর চলে যাবে। একজন মহানগর হাকিমের পক্ষে মাসে গড়ে ৩০টির বেশি মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব নয়।

আদালত সূত্র জানায়, ১৯৭৯ সালের নভেম্বর মাসে একজন মুখ্য মহানগর হাকিম ও তিনজন মহানগর হাকিম নিয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেসির কার্যক্রম শুরু হয়। ওই সময় নগরে থানার সংখ্যা ছিল ছয়টি। জনসংখ্যা ও অপরাধপ্রবণতা বাড়ায় বর্তমানে নগরে থানার সংখ্যা ১৬টি। ১৯৯২ সালে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেসিতে বিচারাধীন মামলা ছিল ৮ হাজার ৫৬৭টি। মামলা বাড়ার কারণে ওই বছর মহানগর হাকিমের সংখ্যা বৃদ্ধি করে পাঁচে উন্নীত করা হয়। মামলার সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাওয়ায় অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিমের একটি পদ বাড়ানো হয় ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ২০০৭ সালে মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১৫ হাজার ১০৬টি হওয়ায় পরের বছর আরেকটি মহানগর নগর হাকিমের পদ বাড়ানো হয়। ২০০৭ সালের তুলনায় বর্তমানে মামলার সংখ্যা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেসিতে বিচারকের সংখ্যা বাড়াতে আইন মন্ত্রণালয়কে জেলা আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে বলে জানান সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আইয়ুব খান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, মামলার সংখ্যা বাড়ায় বিচারকের সংখ্যাও বাড়ানো প্রয়োজন। এতে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হবে। কমবে মামলাজট ও বিচারপ্রার্থীর দুর্ভোগ।