জন্মস্থান কুলাউড়ার উদ্দেশে রওশন আরা বাচ্চুর শেষযাত্রা

ভাষাসৈনিক রওশন আরা বাচ্চু। ফাইল ছবি
ভাষাসৈনিক রওশন আরা বাচ্চু। ফাইল ছবি

শেষবার বাংলা একাডেমিতে এসেছিলেন ভাষাসৈনিক রওশন আরা বাচ্চু। তাঁর কাফনে মোড়ানো নিথর দেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান অনুরাগী, সহযোদ্ধা, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। পড়ন্ত বেলায় সেখান থেকে তাঁর মরদেহবাহী গাড়ি বেরিয়ে গেল সাইরেন বাজিয়ে। গন্তব্য মৌলভীবাজারে কুলাউড়া উপজেলার উছলাপাড়া গ্রামে তাঁর নিজ বাড়িতে। সেখানেই পারিবারিক কবরস্থানে হবে ভাষার জন্য সংগ্রাম করা মহীয়সী নারী রওশন আরা বাচ্চুর দাফন।

আজ মঙ্গলবার এই ভাষাসৈনিক মারা যান।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ রওশন আরার মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী এক শোকবার্তায় ভাষাসৈনিক রওশন আরার অবদানের কথা স্মরণ করেন। প্রধানমন্ত্রী মরহুমার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা ও তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।

মূলত বার্ধক্যজনিত সমস্যা ছিল রওশন আরা বাচ্চুর। পাশাপাশি নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন। গত রোববার তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। সেদিন ইমার্জেন্সিতে তিন ঘণ্টা রেখে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়া হয়। রওশন আরা বাচ্চুর ছোট মেয়ে তাহমিদা খাতুন প্রথম আলোকে এ তথ্য দেন। তিনি জানান, আজ রাতে পশ্চিম মণিপুর বায়তুল আমান জামে মসজিদে জানাজা শেষে তাঁরা মরদেহ নিয়ে যাত্রা শুরু করেন মৌলভীবাজারের উদ্দেশে। কাল বুধবার সকালে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার উছলাপাড়ায় তাঁর মাকে দাফন করা হবে। তাঁর চার মেয়ে। স্বামী শামসুদ্দীন মোহাম্মদ আবদুল তৈমুর মারা গেছেন ২০১৭ সালে।

আজ বাংলা একাডেমিতে নিয়ে আসা হয় বিকেল চারটায়। বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে তাঁর শ্রদ্ধানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এখানে রওশন আরা বাচ্চুর প্রতি ব্যক্তিভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, জাতীয় অধ্যাপক ভাষাসংগ্রামী রফিকুল ইসলাম, নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, লোকগবেষক শামসুজ্জামান খান, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী, ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেল, প্রাবন্ধিক মোনায়েম সরকার প্রমুখ। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করে বাংলা একাডেমি ও লেখিকা সংঘ।

শ্রদ্ধানুষ্ঠানে রওশন আরা বাচ্চুর ছোট মেয়ে তাহমিদা খাতুন বলেন, ‘বিভিন্ন জায়গায় ইংরেজিতে সাইনবোর্ড দেখলে মা কষ্ট পেতেন। তিনি সব সময় এর বিরুদ্ধে বলতেন। তিনি বিশ্বব্যাপী বাংলা ভাষাকে ছড়িয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। এটি হলেই আমার মায়ের আত্মা শান্তি পাবে।’

আনিসুজ্জামান বলেন, ‘৫২ সালে তিনি ভাষাসংগ্রামী হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন। এত বছর বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর মমতা ও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের দাবি জানিয়েছিলেন। আমি তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করি।’

অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, রওশন আরা বাচ্চু অত্যন্ত সাহসী নারী ছিলেন। ভাষা আন্দোলন থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলা ভাষার প্রশ্নে তিনি সর্বদাই সোচ্চার ছিলেন।

রামেন্দু মজুমদার বলেন, ১৯৫২ সালে মেয়েরা প্রকাশ্যে সভা-সমিতি করতে বিব্রতবোধ করতেন। এমনকি বাইরে বেরোতেও বিধিনিষেধ ছিল। সে সময় রওশন আরা বাচ্চু আন্দোলন করেছেন। ভাষাসংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।

হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেন, রওশন আরা বাচ্চুর স্মৃতি রক্ষার্থে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিশ্চয়ই কাজ হবে এবং বাংলা একাডেমি তার দায়িত্ব পালন করবে।

বাংলা একাডেমি থেকে রওশন আরা বাচ্চুর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে। সেখানে তাঁর প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তাঁর পশ্চিম মণিপুরের বাসায়। এশার নামাজের পর সেখানকার বায়তুল আমান জামে মসজিদে তাঁর দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

ভাষাসৈনিক রওশন আরা বাচ্চু ১৯৩২ সালের ১৭ ডিসেম্বর মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার উছলাপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা এ এম আশ্রাফ আলী, মা মনিরুন্নেসা খাতুন। রওশন আরা বাচ্চু ১৯৪৭ সালে পিরোজপুর গার্লস স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর বরিশাল বিএম কলেজ থেকে ১৯৪৯ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯৪৯ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে। ১৯৫৩ সালে অনার্স পাস করেন। রওশন আরা বাচ্চু ‘গণতান্ত্রিক প্রগ্রেসিভ ফ্রন্ট’-এ যোগ দিয়ে ছাত্ররাজনীতি শুরু করেন। তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হল এবং উইমেন স্টুডেন্টস রেসিডেন্সের সদস্য নির্বাচিত হন। রওশন আরা বাচ্চু সর্বশেষ বিএড কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। অবসর নেন ২০০২ সালে।

রওশন আরা বাচ্চুর পরিবার নানাভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল। দাদা আহমদ আলী পড়াশোনা করেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। তিনি ব্রিটিশ সরকারের ইন্সপেক্টর জেনারেল অব রেজিস্ট্রেশনের দায়িত্বে ছিলেন। চাচা ছিলেন কংগ্রেস পার্টির সদস্য।