বাউৎ উৎসবে মাছ ধরার ধুম

শীতের সময়ে কমতে শুরু করেছে বিলের পানি। শুরু হয়েছে বাউৎ উৎসব। পলোসহ বিভিন্ন ধরনের জাল নিয়ে মাছ ধরতে ছুটে এসেছেন শৌখিন মাছ শিকারিরা। পাবনার ভাঙ্গুড়ার রুহুলবিলে।  ছবি: হাসান মাহমুদ
শীতের সময়ে কমতে শুরু করেছে বিলের পানি। শুরু হয়েছে বাউৎ উৎসব। পলোসহ বিভিন্ন ধরনের জাল নিয়ে মাছ ধরতে ছুটে এসেছেন শৌখিন মাছ শিকারিরা। পাবনার ভাঙ্গুড়ার রুহুলবিলে। ছবি: হাসান মাহমুদ

‘ঝপ ঝপাঝপ পলো বাও/ মজার মজার মাছ খাও’—একটা সময় চলনবিলে মাছ ধরার উৎসবে এই স্লোগান শোনা যেত মানুষের মুখে মুখে। ওই স্লোগান এখন আর তেমন শোনা যায় না। বিলে মাছ কমে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে মাছ ধরার উৎসবের ঢঙেও।

তবে বছরের এই সময়ে এসে ধনী-গরিব সব শ্রেণির মানুষের বিলের পানিতে নেমে মাছ ধরার দৃশ্যর কোনো পরিবর্তন হয়নি। সূর্য পুরোপুরি ওঠার আগেই শিশিরভেজা গ্রামের পথে বিলমুখী মানুষের সারি, হাতে মাছ ধরার পলো, নারী-পুরুষ, কিশোর-কিশোরীর ঢল নামার দৃশ্য গতকাল মঙ্গলবারও দেখা গেল চলনবিলের রুহুল বিলে।

পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার পার-ভাঙ্গুড়া ইউনিয়নের ওই বিলে মাছ ধরতে নেমেছিলেন, কৃষক, শ্রমিক, চাকরিজীবী-ব্যবসায়ী, চিকিৎসকসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার প্রায় ২০ হাজার মানুষ। চলনবিলে মাছ ধরার এ উৎসব অনেক পুরোনো। যাঁরা পলো দিয়ে মাছ ধরেন, তাঁদের বলা হয় বাউৎ। সে অনুসারে উৎসবেরও নাম হয়েছে বাউৎ উৎসব।

গতকাল উৎসবে যোগ দিয়ে দেখা গেল, পলো, পলো জাল, ঠেলা জাল, চাট জাল নিয়ে বিলের পানিতে নেমেছে আশপাশের ২০ থেকে ২৫ গ্রামের বাসিন্দারা। ঘুরতে ঘুরতে দেখা হলো নাটোর ও সিরাজগঞ্জ জেলা থেকে আসা শৌখিন মাছশিকারিদের সঙ্গেও। সকালের শুরুতে মাছশিকারিদের উৎসাহ দেখে মনে হওয়ার উপায় ছিল না উৎসবে কোনো পরিবর্তন এসেছে। মাছ ধরার সঙ্গে সঙ্গেই বন্দী করছে সঙ্গে রাখা পাতিলে। কারও জালে ধরা পড়ল ছোট শোল, মৃগেল। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাটা পড়ে উৎসবে।

উৎসবে অংশ নেওয়া কয়েকজন মাছশিকারির সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বর্ষায় বিলে থইথই পানি থাকে। তখন বিচ্ছিন্নভাবে মাছ শিকার করা হয়। বর্ষার পর পানি নিচু এলাকাগুলোতে নেমে যায়। সেখানে প্রচুর মাছ জমে। ফলে বিলপাড়ের বাসিন্দারা একত্র হয়ে মাছ শিকারে নামেন। আগে মানুষের চেয়ে মাছ বেশি ছিল। বিলে নেমে কেউ কোনো দিন খালি হাতে ফেরেনি। বড় বড় রুই, কাতলা, বোয়াল, চিতল, শোল ও গজার মাছ পাওয়া যেত। উৎসব হতো টানা কয়েক দিন ধরে। কিন্তু বর্তমানে বিলে মাছ কমে গেছে। ফলে উৎসব এখন সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবার আয়োজন করা হয়।

পাবনার চাটমোহর উপজেলার চাঁদভা গ্রাম থেকে মাছ ধরতে এসেছিলেন লালচাঁদ আলী (৫৫)। আলাপকালে বলছিলেন, শৈশব থেকে প্রায় ৪০ বছর বিলে মাছ ধরছেন। প্রতিবছর উৎসবে অংশ নেন। কিন্তু মাছের এমন আকাল আগে আর দেখেননি। ভাঙ্গুড়া উপজেলার রাঙ্গুলিয়া গ্রামের ফজের আলী (৬০) বলেন, ‘পুঞ্চাইশ বছরে এত কম মাছ ইবারই দেখলেম। মাছ ছোট থাকতিই বেড়জাল, কারেন জাল, সুতিজাল দিয়ে সব ছেকে তুলা হচ্ছে। তাই বড় মাছ আরও পাওয়া যাচ্ছে না।’

ভাঙ্গুড়া টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজের অধ্যক্ষ বদরুল আলমও এসেছিলেন উৎসবে। তাঁর মতে, এই উৎসব পাবনার ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। উৎসবে ধনী-গরিবে ভেদাভেদ থাকে না, সবাই মিলেমিশে উৎসবে মাতেন, মাছ নিয়ে খুশিমনে বাড়ি ফেরেন। কিন্তু দিনে দিনে বিলে মাছ কমে যাচ্ছে। বর্ষার ডিম ছাড়ার সময় থেকেই ছোট মাছ ছেঁকে তোলা হচ্ছে। ফলে উৎসবে মাছ মিলছে না। এভাবে চললে ভবিষ্যতে এ উৎসবও আর থাকবে না।

পাবনার লোকসংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা করেছেন পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবদুল আলীম। উৎসব নিয়ে তিনি বলছিলেন, সারা বছর কৃষক মাঠে ফসল ফলান আর বর্ষা থেকে মাছ ধরা শুরু করেন। এ জন্যই হয়তো ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ প্রবাদটা এসেছে। প্রাপ্য দাম না পাওয়ায় ধান কাটার উৎসবে যেমন ভাটা পড়েছে, মাছ না পেলে হয়তো বাউৎ উৎসবও বিলুপ্ত হবে একদিন।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবদুর রউফ প্রথম আলোকে বলেন, মাছগুলো সংরক্ষণের জন্য অভয়াশ্রম তৈরি ছাড়া বিকল্প নেই।