৩০ বছর ভিজিয়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে

সোগেরা মোর্শেদ সালামের বয়স আটকে আছে ৩৪ বছরে। তবে তাঁর স্বামী আবদুস সালাম চৌধুরী এবং তিন মেয়ের বয়স বেড়েছে গত সাড়ে ৩০ বছরে। রাজধানীর গুলশানে বাসার দেয়ালের কয়েকটি ছবি সাড়ে ৩০ বছর আগের। আর অন্য ছবির মানুষগুলোর জীবনের বিভিন্ন সময়ের ছবি দিয়ে সাজানো। সোগেরা না থাকলেও পরিবারের সদস্যরা তাঁকে ঠিকই মনে রেখেছেন। আর যন্ত্রণায় অহরহ দগ্ধ হচ্ছেন তাঁরা। মমতাময়ী সোগেরাকে তাঁরা তিনটি দশক ধরে ভিজিয়ে রেখেছেন দুই নয়নের জলে।

১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই সোগেরা মোর্শেদ সালাম রাজধানীর রাজারবাগ বাসা থেকে ভিকারুননিসা নূন স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া বড় মেয়েকে আনতে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তের কবলে পড়েন। তাঁকে গুলি করে দুর্বৃত্তরা। হাসপাতালে নেওয়ার পথে সোগেরা মারা যান। সেদিনই রমনা থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন তাঁর স্বামী আবদুস সালাম চৌধুরী। এ হত্যাকাণ্ড তখন তুমুল আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। সম্প্রতি আবার আলোচনায় এসেছে এ ঘটনা।

অ্যালবামে স্মৃতি খুঁজে ফিরছেন সোগেরা মোর্শেদ সালামের মেয়ে সামিয়া সারওয়াত চৌধুরী। ছবি: মানসুরা হোসাইন
অ্যালবামে স্মৃতি খুঁজে ফিরছেন সোগেরা মোর্শেদ সালামের মেয়ে সামিয়া সারওয়াত চৌধুরী। ছবি: মানসুরা হোসাইন

১৪ নভেম্বর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, পারিবারিক বিরোধের জের ধরে ভাশুর, ভাশুরের স্ত্রী ও শ্যালক মিলে সোগেরাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। তাঁরা ভাড়াটে সন্ত্রাসী দিয়ে সোগেরাকে হত্যা করান। ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে সোগেরা হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন মারুফ রেজা, আনাস মাহমুদ, আনাসের দুলাভাই চিকিৎসক হাসান আলী (ভাশুর) চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা শাহীন (আনাসের বোন)।

আবদুস সালাম বলেন, ‘শুধু হিংসা থেকেই তাঁরা আমার স্ত্রীকে হত্যা করেন। আমার স্ত্রীর পড়াশোনা, আচরণ সবকিছুর জন্য আমার মা তাঁকে খুব ভালোবাসতেন, যা আমার ভাবি মেনে নিতে পারতেন না। আমার স্ত্রী বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) রিসার্চ ইকোনমিস্ট ছিলেন। আমি চার কাঠা জায়গায় একটি বাড়ি করেছিলাম। এসবই খুনের সঙ্গে অভিযুক্তরা সহ্য করতে পারতেন না। অথচ আমরা তিন ভাইই উচ্চশিক্ষিত। আমি শিক্ষক, একজন চিকিৎসক, একজন ইঞ্জিনিয়ার। শিক্ষিত একটি পরিবারের সদস্য হয়েও শুধু হিংসা থেকে আমার স্ত্রীকে হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকায় এখন সবাই অভিযুক্তদের ধিক্কার দিচ্ছে। এমনকি আমার স্ত্রী মারা যাওয়ার পরও কিন্তু তাঁদের হিংসা থামেনি।’

মেয়ে সামিয়া সারওয়াত চৌধুরীর সঙ্গে সোগেরা মোর্শেদ সালামের স্বামী আবদুস সালাম। ছবি: মানসুরা হোসাইন
মেয়ে সামিয়া সারওয়াত চৌধুরীর সঙ্গে সোগেরা মোর্শেদ সালামের স্বামী আবদুস সালাম। ছবি: মানসুরা হোসাইন

সম্প্রতি সোগেরার পরিবারের সদস্যরা সাড়ে ৩০টি বছর কেমন করে পার করলেন, তা জানতেই গুলশানের বাসায় যাওয়া। বাসার বিভিন্ন ঘরের দেয়ালে সোগেরা মোর্শেদের সাদা–কালো ছবি টাঙানো। কয়েকটি ছবি তিন মেয়ে আর স্বামীর সঙ্গে। তবে ছবিগুলো ঝাপসা হয়ে আসছে। আর ঝাপসা ছবির সঙ্গেই মেয়েদের উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়া, বিয়ে, সন্তানদের সঙ্গে ছবি টাঙানো। এই বাসায় থাকেন সোগেরার স্বামী এবং এক মেয়ে সামিয়া সারওয়াত চৌধুরী। সোগেরা মারা যাওয়ার সময় এই মেয়ের বয়স ছিল ৬ বছর। অ্যাকাউন্টিং ও হিউম্যান রিসোর্সে মাস্টার্স ও এমবিএ করা সামিয়া একটি নামকরা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। তবে এখন আর চাকরি করছেন না। ছুটির দিনে সন্তানকে নিয়ে সামিয়া চলে যান শ্বশুরবাড়ি। তখন পুরো বাড়িতে সুনসান নীরবতা। সোগেরার বড় মেয়ে সারাহাত সালমা চৌধুরী অস্ট্রেলিয়ায় মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটি এবং ছোট মেয়ে সিফাত সাদিয়া চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রের ক্যানসাস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। সোগেরা মারা যাওয়ার সময় সিফাতের বয়স ছিল মাত্র দুই বছর।

সোগেরার স্বামী আবদুস সালাম চৌধুরী গত বছর বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল টিউটোরিয়াল স্কুল থেকে অবসর নেন। এ স্কুলে তিনি ৩২ বছর শিক্ষকতা করেন। অবসর নেওয়ার আগে স্কুলটির অর্থনীতি বিভাগের প্রধান এবং এ লেভেলের সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করেন। এখন তাঁর সময় কাটে অর্থনীতি, জিওগ্রাফিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করে। দেশে থাকা একমাত্র নাতনিকে স্কুলে দিয়ে আসেন। টেলিভিশন চ্যানেলে খবরসহ অন্যান্য জিনিস দেখেন। বলেন, ‘স্ত্রীর স্বাভাবিক মৃত্যু হলে ছোট ছোট তিন মেয়ের কথা চিন্তা করে হয়তো আবার বিয়ে করতাম। কিন্তু স্ত্রীর হত্যাকাণ্ড সবকিছু ওলটপালট করে দেয়। যখন বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করি, তখন আর স্বাভাবিক থাকতে পারি না।’

১৯৮৯ সালে খুন হন সোগেরা মোর্শেদ সালাম। ছবি: মানসুরা হোসাইন
১৯৮৯ সালে খুন হন সোগেরা মোর্শেদ সালাম। ছবি: মানসুরা হোসাইন

সোগেরা আবদুস সালামের মেজ মেয়ে সামিয়া সারওয়াত চৌধুরীর মাকে নিয়ে তেমন কোনো অভিজ্ঞতার কথা মনে নেই। বলেন, ‘বাবা আমাদের জন্য অনেক করেছেন। আমাদের বয়ঃসন্ধিকালের নানা জটিলতায় নানি ও খালাদের পাশে পেয়েছি। মূলত খালাদের কাছেই মায়ের আদর পেয়েছি। কিন্তু নিজের মায়ের আদর তো না। তাই এ আফসোস তো থাকবেই সারা জীবন।’

অন্যদিকে সারাহাত সালমা চৌধুরীর চোখের সামনে এখনো অনেক কিছুই ভাসে। অস্ট্রেলিয়া থেকে মুঠোফোনে বলেন, তাঁকে স্কুল থেকে আনতে গিয়েই তাঁর মা খুন হন। সারাহাত ভিকারুননিসা নূন স্কুলের দিবা শাখার ছাত্রী ছিলেন। স্কুলে দিয়ে মা নিতে আসবেন বলেছিলেন। তবে সেদিন সন্ধ্যায় ছোট সারাহাত হাসপাতালে গিয়ে স্ট্রেচারে তাঁর ‘আম্মি’র নিথর মুখটা দেখেছিলেন, যা তিনি সারা জীবনেও ভুলতে পারবেন না। তখন কেউ কেউ বলেছিলেন, সোগেরা মারা যাওয়ার আগেও ‘মেয়েটা স্কুলে থেকে গেল’—এ কথা বলেছিলেন বলেও শুনেছেন সারাহাত।
সারাহাত প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের পাশাপাশি মহামান্য হাইকোর্টের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। মামলাটি পুনর্বার তদন্তের জন্য না পাঠালে হয়তো অভিযুক্তরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যেত। সারাহাতের মতে, শুধু তাঁদের মাকে হত্যা করা হয়নি, মায়ের সঙ্গে সঙ্গে হত্যা করা হয়েছে তাঁদের ৩০ বছরের দীর্ঘ জীবন।

সোগেরা মোর্শেদ সালামের স্মৃতি ধরে রেখেছেন পরিবারের সদস্যরা। ছবি: মানসুরা হোসাইন
সোগেরা মোর্শেদ সালামের স্মৃতি ধরে রেখেছেন পরিবারের সদস্যরা। ছবি: মানসুরা হোসাইন

বাবার সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে সারাহাত অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রকাশিত প্রশান্তিকা নামের এক বাংলা পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘সবার ছোট বোনটির বয়স ছিল দুই বছর। ঘুমানোর সময় মাকে ছাড়া ঘুমাতে চাইত না সে। আব্বু আলমারি থেকে আম্মির শাড়ি বা ওড়না বের করে মাথায় ঘোমটা দিয়ে ওকে ফিডারে দুধ খাওয়াতেন। ও আব্বুকে তখন আম্মি মনে করে দুধ খেতে খেতে ঘুমাত।’

সোগেরা আর আবদুস সালাম চৌধুরী ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে একসঙ্গে পড়াশোনা করেছেন। তাঁরা দুজন ছিলেন ‘রিডিং পার্টনার’। আবদুস সালাম বলেন, তাঁরা সেই অর্থে তখন প্রেম করেননি। তবে ভালো লাগা ছিল। তারপর পারিবারিকভাবেই ১৯৭৯ সালের ২৫ অক্টোবর তাঁদের বিয়ে হয়। সংসার জীবন ছিল ৯ বছর ৯ মাসের। এই দম্পতি ১৯৮০ সালে ইরাক চলে যান। ১৯৮৪ সালের শেষের দিকে তাঁরা দেশে ফেরেন। আবদুস সালামের যে ভাই ও ভাইয়ের স্ত্রী সোগেরাকে হত্যা করেন, তাঁদের সঙ্গে এই দম্পতি এক বাসায় ছিলেন খুব বেশি হলে তিন থেকে চার বছর। আবদুস সালাম ২০০৯ সালে গুলশানের নিজস্ব ফ্ল্যাটে চলে আসেন।

আবদুস সালাম বলেন, ‘সোগেরা হত্যা মামলাটি চাঞ্চল্যকর মামলা ছিল। বাংলাদেশ ছাড়াও আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের বাংলা পত্রিকায় এ খবর ফলাও করে ছাপা হয়েছিল। তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে বাসায় এসেছিলেন। ভিকারুননিসা নূন স্কুলের অভিভাবকেরা তিন দিন মিছিল করে বিক্ষোভ করেছেন। তারপর যা হয়, একসময় সবাই মামলার কথা ভুলে যান। এত দিনে আমরাও বিশ্বাস করতাম, এ মামলার আর কিছু হবে না। ডিপ ফ্রিজে চলে যাওয়া মামলাটিই সম্প্রতি আলোচনায় আসে। পিবিআইকে ধন্যবাদ। এখন মনে হচ্ছে আমরা সুবিচার পাব।’

দেয়ালজুড়ে সোগেরা মোর্শেদ সালামের স্মৃতি। ছবি: মানসুরা হোসাইন
দেয়ালজুড়ে সোগেরা মোর্শেদ সালামের স্মৃতি। ছবি: মানসুরা হোসাইন

স্ত্রী খুন হওয়ার পর ছোট ছোট তিন মেয়েকে নিয়ে চোখে অন্ধকার দেখেছিলেন আবদুস সালাম। বলেন, ‘দরজার নিচ দিয়ে খুনিদের পক্ষ থেকে চিরকুট আসতে থাকে। তিন মেয়ের নিরাপত্তার বিষয়টি বড় হয়ে দেখা দেয়। মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা। ইনকামও তেমন ছিল না। তবে অর্থনৈতিক অবস্থা বেশি দিন খারাপ থাকেনি। বাসায় টিউশনির জন্য ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বেড়ে যায়। আমার যে স্টুডেন্ট ভালো ভালো অবস্থানে ছিল, তারাও হেল্প করেছে বিভিন্ন বিষয়ে। শিক্ষার্থীদের কোচিং করাতাম আর ফাঁকে দেখে যেতাম মেয়েরা কী করছে। মেয়েরা পড়াশোনায় মনোযোগী ছিল, তাই পড়াশোনা নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়নি।’

চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত সোগেরা মোর্শেদ খুনের মামলাটি ২৬ জন তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত করেন। ১১ জুলাই হাইকোর্ট পিবিআইকে অধিকতর তদন্ত করার নির্দেশ দেন। সোগেরা মোর্শেদ সালাম হত্যার ঘটনায় করা মামলা অধিকতর তদন্তে আরও ৬০ দিন সময় পেয়েছে পিবিআই। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। এর আগে এ মামলার কার্যক্রমে দেওয়া স্থগিতাদেশ গত ২৬ জুন হাইকোর্ট প্রত্যাহার করে পিবিআইকে ৬০ দিনের মধ্যে অধিকতর তদন্ত শেষ করতে নির্দেশ দেন। পরে তদন্তের স্বার্থে সময়ের আবেদন জানানো হলে গত ২৯ আগস্ট হাইকোর্ট ১২০ দিন সময় দেন।

আবদুস সালাম বলেন, ‘মেয়েদের বড় করতে গিয়ে আমার ক্যারিয়ার সে অর্থে ডেভেলপ হয়নি। এরপরও বলব, আমি ভালো আছি। আমাকে সম্মান করে অনেকেই ‘সালাম স্যার’ বলে সম্বোধন করেন। তিন মেয়েই আজ প্রতিষ্ঠিত এবং ভালো আছে। এখন স্ত্রী হত্যার সুবিচার দেখে যেতে পারলেই আর কিছু চাওয়ার নেই।’