চাই একটু ভালোবাসার পরশ

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পরশ আয়োজিত অনুষ্ঠানে গান করছেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা।  সংগৃহীত
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পরশ আয়োজিত অনুষ্ঠানে গান করছেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা। সংগৃহীত

‘অর্থ নয় ধন নয় চাই একটু পরশ, স্নেহ মমতা পেলে হয়ে যাব সরস।’ প্রথম শোনাতেই কথাটি মনে ধরেছে। কথাটি একদল প্রতিবন্ধী শিশু–কিশোর, তরুণ–তরুণীর। তারা একটু মায়া–মমতার পরশ চায় এই সমাজের কাছে। এই চাওয়া থেকেই তারা একত্র হয়েছে এক ছাতার নিচে। গড়ে তুলেছে ‘পরশ’ নামে একটি সংগঠন, কাজ করে যাচ্ছে প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে।

পরশের কয়েকজন কর্মীর সঙ্গে সেদিন মুখোমুখি হয়েছিলাম। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল মো. ইব্রাহিম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকের শিক্ষার্থী। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী তিনি। কিন্তু এটা তাঁর কাছে কোনো বাধা নয়। বড় বাধা হচ্ছে সমাজ, এই সমাজের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি। শুরুতেই ফয়সাল ছোট একটি উদাহরণ দিয়ে বললেন, ‘যেমন ধরুন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজকেরা প্রতিবন্ধীদের নিয়ে যান তাঁদের সমাজকল্যাণমূলক কাজের প্রদর্শনী হিসেবে। যাওয়ার সময় খুব আদর–যত্ন করলেন। কিন্তু ফেরার সময় আর কোনো খবর নেই। প্রতিবন্ধীদের তো চলতে–ফিরতে সমস্যা হয়। সে বিষয়ে কোনো তদারক নেই। এসব দিক বিবেচনা করে নিজেরাই একটি সংগঠন গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছি।’

এ বছর এপ্রিলে এই সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এতে প্রায় ২০০ জন সাধারণ সদস্য রয়েছে। তাদের বেশির ভাগই দৃষ্টি এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী। রয়েছে কিছু স্বাভাবিক বন্ধু সদস্য। কার্যকরী সদস্য রয়েছে ১১ জন। তার মধ্যে ৮ জনই প্রতিবন্ধী। প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার সুযোগ, খেলাধুলা, চাকরি, রোগ–শোক সর্বোপরি অধিকার আদায়সহ নানা বিষয় নিয়ে সংগঠনটির কাজ করার ইচ্ছা রয়েছে। উপদেষ্টা হিসেবে আছেন চট্টগ্রাম সরকারি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ও মূক বধির বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক আবদুস সামাদ।

আবদুস সামাদ বলেন, ‘দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা নানাভাবে অবহেলিত। তারা অনেক কষ্ট করে পড়ালেখা করে। কিন্তু কোথাও চাকরির সুযোগ নেই। তবে কিছুদিন ধরে একটি পোশাক কারখানায় কয়েকজন প্রতিবন্ধীকে চাকরি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেটা এই সংগঠনের মাধ্যমে আমরা করেছি।’ তিনি মনে করিয়ে দিলেন একসময় শিশু পার্ক, চিড়িয়াখানায় প্রতিবন্ধীদের ঢুকতে টিকিট লাগত। কিন্তু এখন টিকিট লাগে না। প্রতিবন্ধী হলেই ঢুকতে দেয়। এই অধিকারটা আদায় করতে হয়েছে।

‘পরশ’ গত সেপ্টেম্বর মাসে নগরের ফয়সলেক কনকর্ড এমিউজমেন্ট পার্কে এইচএসসি কৃতী শিক্ষার্থী সংবর্ধনা ও ক্রীড়া এবং সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। এতে প্রায় দুই শতাধিক প্রতিবন্ধী অংশগ্রহণ করে। সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ও পার্ক কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় এই অনুষ্ঠান তারা করেছে।

সংগঠনের ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক সুরত আলম বলেন, ‘প্রতিবন্ধীদের মধ্যে অনেক উজ্জ্বল প্রতিভা রয়েছে। তারা গান, আবৃত্তি এবং বিভিন্ন খেলাধুলায় পারদর্শী। পরশ এই বিষয়টি নিয়েও কাজ করছে। ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ক্রিকেট দল গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া দাবার জাতীয় আসরে অংশ নিচ্ছি আমরা।’

এই সংগঠনটি বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রে অনুষ্ঠানও করেছে। সেখানে প্রতিবন্ধীরা গান, আবৃত্তি পরিবেশন করে। এটা তাদের কাছে অনেক অনুপ্রেরণাদায়ক বলে মনে করছে পরশ। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের পরীক্ষার সময় সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় শ্রুত লেখক পাওয়া। পরশ ইতিমধ্যে পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী এবং অষ্টম শ্রেণির জেএসসিসহ বিভিন্ন পরীক্ষায় শ্রুত লেখক খুঁজে দেওয়ার কাজটি করে যাচ্ছে। এ ছাড়া ব্রেইল বই প্রাপ্তির বিষয়টিও গুরুত্ব সহকারে দেখছে তারা।

সংগঠনের সভাপতি মো. রফিকুজ্জামান। তিনি হোমিওপ্যাথি কলেজের শিক্ষক। নিজে সুস্থ স্বাভাবিক হলেও রফিকের এক ভাই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। তাই তিনি প্রতিবন্ধীর ব্যথা বোঝেন। রফিকুজ্জামান বলেন, প্রতিবন্ধীদের দক্ষতা বৃদ্ধি, প্রযুক্তিগত মানোন্নয়নসহ বিভিন্ন দিক নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা আছে। প্রতিবন্ধীদের মধ্যে মেধা রয়েছে। তারা সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের কাজও করতে পারে। কিন্তু সুযোগ পাচ্ছে না। সেই সুযোগটি করে দেওয়ার জন্য তাদের সঙ্গে আমরা একত্র হয়েছি। প্রাথমিকভাবে একটি প্রতিবন্ধীবান্ধব গ্রন্থাগার এবং কম্পিউটার ল্যাব করার ইচ্ছা রয়েছে বলে জানান তিনি।

এখনো সংগঠনটির নিজস্ব কোনো ঠিকানা নেই। তারপরও অনেক বড় বড় স্বপ্ন রয়েছে এসব প্রতিবন্ধীর মনে। তারাও স্বাভাবিকের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল হতে চায়। তাদের এই স্বপ্ন সফল করার জন্য কিছু বন্ধু সদস্য সঙ্গে আছে। কিন্তু সফল হওয়ার জন্য আরও অনেক দূর যে পাড়ি দিতে হবে। এ জন্য দরকার সমাজের সচেতন প্রতিবন্ধীবান্ধব মানুষের সহযোগিতা। তাঁদের পরশে হয়তো মিলবে একটি ঠিকানা, যেখানে সমবেত হয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিকল্পনা করতে পারবে প্রতিবন্ধীরা।